চিরদিনের চিরকিশোর
সেদিন কথা হচ্ছিল কুনাল দাস-এর সাথে দমদম রেল ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মের একটি চায়ের
দোকানে । কুনাল একজন ট্রেন সিঙ্গার (Rail Singer) । যারা আমার মতো শিয়ালদহ মেইন লাইনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন
তাঁরা রোগা ক্ষয়াটে চেহারার কুনাল-কে
চিনবেন তাঁর গানের জন্য । প্রায় প্রত্যেকদিন সকাল ১০ টা নাগাদ সাত বছরের
ছোট্ট মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কুনাল তাঁর পোর্টেবেল স্পীকার ও মাইক্রোফোন নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে কাঁচরাপাড়া ষ্টেশন সংলগ্ন একটা বস্তি থেকে । বেরনোর আগে অবশ্যই নিয়ম
করে বাবা মায়ের ছবিতে ভক্তিভরে প্রনাম করে তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঘরের এককোণে
টাঙানো আর একটি ছবির দিকে, যাকে কুনাল প্রত্যেকদিন পুজো করে ভগবানের মতো, তিনি আর
কেউ নন স্বয়ং কিশোর কুমার । কুনালের কথায়
জানা গেল বিগত পাঁচ বছর ধরে ট্রেনে শুধুমাত্র কিশোর কুমারের গান গেয়ে তার পরিবারের
পেট চলে । কি শীত কি বর্ষা বারোমাস কিশোরকুমার কুনালের মতো সঞ্জয়, আদিল, মনসুর,
প্রশান্ত দের ট্রেনে সফর সঙ্গী ।
সর্বসাকুল্যে আধ ঘণ্টা কি এক ঘণ্টা এরা পর পর কিশোরকুমারের গাওয়া হিট
গানগুলি গেয়ে নিত্যযাত্রীদের একটু আনন্দ দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে তার বদলে
নিত্যযাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ দু দশ টাকা এদের হাতে তুলে দেয় । তারপর দিনের শেষে ক্লান্ত
হয়ে বাড়ি ফেরার পথে সেই টাকায় তারা নিজের ছোট্ট মেয়েটি বা ছেলেটির জন্য নিয়ে যায়
রাস্তার সস্তা এগ রোল যেটা খেতে বাচ্ছাগুলো খেতে খুব ভালোবাসে । অবুঝ
ছোট্ট বাচ্ছাগুলো হয়তো জানে না বাবা তাদের আবদার মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে যার
পিছনে রয়েছে ঘরের কোনে টাঙানো কিশোরকুমার নামক এক দেবতার আশীর্বাদের জন্য । আজ কিশোরকুমারের মৃত্যুর প্রায় ৩১ বছর পরেও
তাঁর গান যে কতটা জনপ্রিয় এই ঘটনা তার একটা ছোট্ট নমুনা । আজও গায়ক কিশোরকুমারের গানের জনপ্রিয়তায় এতটুকু
চিড় ধরে নি ।
১৯৩৬ সালে বম্বে টকিজের ‘জীবন নাইয়া’ ছবিতে দাদামনি অশোককুমার স্বকণ্ঠে একটা
গান গেয়েছিলেন – ‘কোই হামদাম না রহা/কোই সাহারা না রহা’ । (https://www.youtube.com/watch?v=gUpJ3-QG-fs) গানটি সেই সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল । ‘ঝুমরু’
ছবিতে পরিকল্পনা চলাকালীন একদিন কিশোর তাঁর মনোবাসনার কথা তাঁর দাদামনি
অশোককুমারকে জানালেন । কি সেই মনোবাসনা ? না কিশোরকুমার ‘ঝুমরু’ ছবিতে এই গানটাই নতুন
করে গাইবেন কারন এই গানটি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় । এটা শুনে দাদামনি হেসে বলেন, ‘ওরে পাগল ছেলে, তুই এই গান গাইবি কিরে ? গানটা যতটা সোজা ভাবছিস
তা কিন্তু নয়, এটা খুব কঠিন একটা রাগের উপর গান যেটা গাইতে আমাকেও খুব কসরত করতে
হয়েছিল । এত কঠিন গান তুই ঠিকমত গাইতে পারবি না ।‘ ততদিনে কিশোরকুমার গায়ক হিসাবে একটু আধটু নাম
করেছেন । তবুও ভাই ওই গানটি ঠিকমত গাইতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে অশোককুমার সন্দেহ
প্রকাশ করেছিলেন । কিন্তু ছোটভাই কিশোরতো ছাড়বার পাত্র নন । দাদামনির কথা শুনে জেদের
সঙ্গে বলে বসলেন, ‘গানটা কোন রাগের উপর তা অতশত জানি না দাদা, তুমি যদি অনুমতি দাও
তাহলে এটা আমি আমার মতো করে গাইব’ । অবশেষে দাদামনি অনুমতি
দিলেন ভাইকে । কিশোর কুমার গাইলেন সেই গান একেবারে নিজের মতো করে, তারপরের
ইতিহাসতো সবার জানা । ১৯৬১ সালে ‘ঝুমরু’ ছবিটি রিলিজ করল এবং গানটিও সাঙ্ঘাতিক হিট
করল । গানটিতে লিপ দিয়ে ছিলেন স্বয়ং
কিশোরকুমার । কিশোরের অজস্র হিন্দি গানের মধ্যে
সেরা দশটি গান যদি বাছতে বলা হয় তাহলে এই গানটি অবশ্যই থাকবেই । (https://www.youtube.com/watch?v=YmmX30DoXdM ) পরে অশোককুমার বলেছিলেন
গানটা গাইবার সময় কিশোরের মুড একটি জায়গায় পৌঁছেছিল এবং তার পাশাপাশি ছিল অসম্ভব
আত্মবিশ্বাস । যেটা যে কোন গানকে একটা উচ্চতায় পৌঁছে দেয় । আদায় করে নেয় শ্রোতার সমীহ । আর এখানেই কিশোরকুমার একশো ভাগ
সফল ।
দুই ভাইএর সাথে
এক ফ্রেমে কিশোর – মাঝখানে দাদামনি অশোক কুমার
ও অনুপ কুমারের সাথে
গায়ক হিসাবে কিশোরকুমারকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে দুজনের অবদান কখনও ভোলার নয়
। তাঁরা হলেন শচীন দেব বর্মণ ও চিরতরুন নায়ক দেব আনন্দ । তাঁরা পাশে না থাকলে কিশোর কুমার হয়তো আমাদের
কাছে অধুরা হয়ে থাকতেন । পঞ্চাশের দশক
জুড়ে রোমান্টিক নায়ক হিসাবে দেব আনন্দের উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তার কিছুটা গায়ক
কিশোরকুমারের কপালেও জুটেছিল । কারন, দেব
সাহেবের ইচ্ছায় তাঁর প্রতিটি ছবিতে কিশোর অন্তত একটি করে গান গেয়েছেন এবং সেটা ছিল
দেব সাহেবের লিপ-এ । এর পাশাপাশি কিশোর
কুমারের মাথার উপর ছিল শচীনকর্তার আশীর্বাদের হাত । পঞ্চাশের দশকে দেব আনন্দের পর পর চারটি ছবি
মুনিমজি, পেইংগেস্ট, ফাণ্টুস ও ন দো গেরা ছবিগুলি সুপারহিট হয় আর দেব সাহেবের
প্রায় সব কটি ছবিরই সংগীত পরিচালক থাকতেন শচীনকর্তা । ব্যাস, কিশোরকে আর পিছনে
ফিরে তাকাতে হয় নি । নিজের ছোট ভাইয়ের দেখতেন কিশোরকে । পরে শচীনপুত্র রাহুলদেবও হিন্দি ছবির গানের
ব্যাপারে তাঁর প্রিয় কিশোরদাকে ছাড়া একপাও নড়তেন না ।
কিশোরদা ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে পারতেন না রাহুলদেব
বাবার সাথে কাজ করতে করতে রাহুলদেব বুঝেছিলেন গানের ব্যাপারে কিশোর কুমার খুব
সিরিয়াস, ছবিতে যার লিপে যে গানই হোক না কেন কিশোরকুমার তাঁর নিজস্ব গায়ন ভঙ্গীতে
তার একটা অসামান্য রূপ দিতেন । গানেরও যে
একটা অবয়ব হতে পারে সেটা একমাত্র কিশোরকুমার অনুভব করিয়েছিলেন । সন্তানস্নেহে প্রতিটি গানকে তিনি বুকে আঁকড়ে
ধরে অসম্ভব দরদ দিয়ে গাইতেন । হিন্দি ছবির
তাবড় তাবড় হিরোরা কিশোরের গানে লিপ দেবার
জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত । এই প্রসঙ্গে রাজেশ খান্নার নাম করতেই হয় । রাজেশ খান্না তাঁর ফিল্মি
কেরিয়ারের প্রায় আশিভাগ ছবিতে কিশোরকুমারের লিপে গান গেয়েছেন ।
কিশোরকুমারের বেশ কিছু গানের মধ্যে ইয়ডলিং এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । যেটা সেই গানগুলো কে একটা বিশেষ জায়গায় পৌঁছে
দিত । চারের দশকে হলিউড কাঁপানো ড্যানি কে (Danny
Kaye) ছিলেন কিশোরকুমারের আইডল । হলিউডের এই
স্টার গায়ক অভিনেতার অভিনয়, গান গাইবার ভঙ্গী, অবিশ্বাস্য ইয়ডলিং, ম্যানারিজমের
সঙ্গে কিশোরকুমারের প্রচুর মিল । ইয়ডলিং এর শুরু ছিল কথাহীন গানের ভিতর দিয়ে ।
পরে আসে গানের কথা । সুরের মতোই অবিশ্বাস্য কায়দায় কিশোরকুমার ঠিক ড্যানি কে (Danny
Kaye) এর কায়দায় ভেঙ্গে ফেলতে পারতেন যে কোন
গানের লিরিক । ড্যানি কে (Danny Kaye) এর ‘ও বাই জিঙ্গো‘ (https://www.youtube.com/watch?v=SAw7MA8sAIc) গানটি শুনে কিশোরকুমার
এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে লুকোচুরি ছবির ‘শিং নেই তবু নামতার সিংহ’ গানে কিশোর
কুমার প্রয়োগ করেছিলেন অসাধারন সুরের ট্রান্সফরমেশন তার সাথে ছিল ড্যানি কে – এর
সৃষ্ট স্টাকাটো রিদম । (https://www.youtube.com/watch?v=dFKl_5zOMGE)
‘পড়োশন’ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন রাহুলদেব বর্মণ । এই ছবিতে কিশোরের গাওয়া
বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার করে কে সিঙ্গার’ গানটিতে কিশোরকে যোগ্য সংগত দিয়েছিলেন
মান্না দে । গানতো নয় যেন ও বলে আমায় দেখ
তো ও বলে আমায় দেখ । গানটি যারা পর্দায় দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয় হেসে লুটপুটী খেয়েছেন
আমার মতো । (https://www.youtube.com/watch?v=9HwrMGpFaik) এই ছবিতে কিশোরকুমার ছিলেন একটি পার্শ্বচরিত্রে । পরে একটি সাক্ষাৎকারে মান্না দে বলেছিলেন এই
গান রেকর্ড চলাকালীন কিশোরকুমার সুরের ভাঁজে তাঁকে একেবারে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন
। ওর মত প্রতিভাবান গায়ক ও অভিনেতা আমাদের
দেশে বড় একটা জন্মায় নি । কিশোর কোন গান ধরলেই সেই গান একটা অন্য চেহারা নিত ।
কারও কাছ থেকে ন্যূনতম তালিম না নিয়েও কোনদিন ও বেসুরো গায় নি । ঈশ্বরদত্ত একটা প্রতিভা ছিল কিশোরের মধ্যে ।
১৯৬৯, শক্তি সামন্তের ‘আরাধনা’ মুক্তি পেল, এটা বলা যায় কিশোর কুমারের সংগীত
জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় । এর প্রত্যেকটি গান সুপারহিট । আর এই ছবি থেকেই রাজেশ
খান্না লাইমলাইটে আসেন । তাঁর লিপে কিশোর গাইলেন অসাধারন সব হিট গান শচীন দেব বর্মনের সুরে । ছবিতে
‘রূপ তেরা মস্তানা’ গানটির জন্য ১৯৬৯ এ প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান কিশোরকুমার
। (https://www.youtube.com/watch?v=HenA-OUyo0s) কিশোর-রাজেশ জুটির সুত্রপাত হল তার পাশাপাশি শুরু
হল অন্য একটা কিশোর-যুগ । ‘আরাধনা’ ছবির পর আরও সাত বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার
পেয়েছিলেন কিশোর । একটা সময় এমন এলো যে, অমিতাভ বচ্চন, জিতেন্দ্র, রাকেশ রোশন,
রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না প্রমুখ ব্লক বাস্টার নায়করা কিশোরকুমারের গান ছাড়া কোন
ছবিতে সাইন করতেন না । ১৯৮৭ সালের ১২ ই
অক্টোবর মিঠুন চক্রবর্তীর ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’ ছবির ‘গুরু গুরু’ গানটি মেহবুব স্টুডিওতে
রেকডিং করেছিলেন কিশোরকুমার । শোনা যায় এটাই নাকি তাঁর শেষ কাজ । (https://www.youtube.com/watch?v=EnZJ7fCGwbg) । এর সঙ্গে আরও জানা যায়, এর
ঠিক দুদিন আগে রাহুলদেব বর্মণের সাথে ‘জোশিলে’ ছবির জন্য তিনি একটি গান রেকর্ডও
করেছিলেন যেটি রাহুলদেব বর্মণের সাথে তাঁর শেষ কাজ । (https://www.youtube.com/watch?v=SP388egqyiY)
হিন্দি সিনেমার প্রচুর গানের পাশাপাশি বাংলা ছবিতেও কিশোরকুমারের গান
শ্রোতাদের আজও মাতিয়ে রেখেছে । কখনও একক
আবার কখনও ডুয়েট । বাংলা ছবিতে আনুমানিক শ’দেড়েক গান গেয়েছেন কিশোরকুমার ।
লুকোচুরি ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘এক পলকে একটু দেখা’, অনিন্দিতা ছবির
‘ওগো নিরুপমা করিও ক্ষমা’, একটুকু ছোঁয়া লাগে ছবিতে ‘সরস্বতীর সেবা করি’ কবিতা
ছবিতে সলিল চৌধুরির সুরে ‘শুন শুন গো সবে’,
অমানুষ ছবিতে শ্যামল মিত্রের সুরে ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’, প্রতিশোধ ছবিতে
অজয় দাসের সুরে সেই বিখ্যাত গান ‘আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ’, দোলনচাঁপা ছবিতে
কানু ভট্টাচার্যের সুরে ‘ওরে মন পাগল তুই কেন কেঁদে মরিস’, হরিশচন্দ্র শৈবা ছবিতে
রবীন্দ্র জৈনের সুরে ‘ও মা পতিতপাবনী গঙ্গে’ যা আজও ভোলা যায় না । কিশোরকুমার একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে
বাংলা গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরের পাশাপাশি তিনি অজয় দাসের সুরে গান গাইতে
বেশী আনন্দ পান ।
কিশোরকুমারের বাংলা বেসিক গানের সংখ্যা আনুমানিক ৬৬ টি । ‘একদিন পাখি উড়ে
যাবে’, ‘আমি নেই ভাবতেই’, ‘চল যাই চলে যাই’, ‘আমার মনের ময়ূরমহলে’, ‘আমার দ্বীপ
নেভানো রাত’, ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে’ ইত্যাদি সব হিট গান যেগুলি কিশোরকুমার গেয়েছিলেন এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত
পুজোর গান হিসাবে । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে
যাচ্ছে, এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত
‘রাখালচন্দ্র মাতাল’ নামক একটি গীতিয়ালেখ্য, যেটির কথা ও সুর স্বয়ং
কিশোরকুমারের আর এই গীতিয়ালেখ্য-এর সব কটি চরিত্রেই ছিলেন স্বয়ং কিশোরকুমার । এই
গীতিয়ালেখ্যটি শুনলেই বোঝা যাবে শুধু মাত্র গায়কই নন কিশোরকুমার একজন তুখোড় বাচিক শিল্পীও বটে ।
![]() |
ঘরে বাইরে ছবির গান রেকর্ডিং এ পরিচালক সত্যজিত রায়ের সাথে
|
![]() |
প্রথমা স্ত্রী রুমা ও ছেলে অমিতের সাথে |
পরিচালক সত্যজিৎ রায় কিশোরকুমারের নিকট আত্মীয় ছিলেন । শোনা যায়, গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির জন্য
সত্যজিৎবাবু গুপীর লিপের সমস্ত গানগুলি কিশোরকুমারকে গাইবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন
। কিন্তু বম্বেতে কিশোরকুমারের অত্যাধিক
ব্যস্ততার কারনে তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি । যার জন্য কিশোরকুমারের খুব বড় একটা আফসোস
ছিল। অবশেষে ‘চারুলতা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ ছবির মাধ্যমে সেই সুযোগ আসে । সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিগুলিতে কিশোর গেয়েছিলেন,
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ , ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ , ‘চল রে চল সবে
ভারতসন্তান’ এবং ‘বুঝতে নারী, নারী কি চায় গো’ এই চারটি গান । এর মধ্যে ‘বিধির বাঁধন
কাটবে তুমি’ এবং ‘বুঝতে নারী, নারী কি চায়
গো’ এই দুটি গান সত্যজিৎ রায় কিশোরকুমারকে
একেবারে খালি গলায় গাইয়েছিলেন কোনরকম যন্ত্র সঙ্গীত না ব্যবহার করেই । এরপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরনায়
রবীন্দ্রসংগীতের দুটি এলবাম করেছিলেন কিশোর । সর্বমোট ২৪ টি গান । ‘একটুকু ছোঁয়া
লাগে’ , ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’, ‘সহন গহন রাত্রি’ , ‘এই কথাটি মনে রেখো’,
‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ ইত্যাদি সব গান । মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে এলবামটি
প্রকাশের সময় কোম্পানির কর্ণধার কমল ঘোষ জানিয়েছিলেন, ‘কিশোরকুমার যখন
রবীন্দ্রসংগীতের এলবামটি রেকর্ডিং করছেন তখন তিনি অন্য মানুষ । যেন পুজায় বসেছেন
।’ কিশোরকুমারের এই দুটি এলবামই অত্যন্ত
জনপ্রিয় হয়েছিল ।
কিশোর কুমারের অন্যতম ভক্ত গায়ক গৌতম ঘোষ । কিশোরকুমারের পায়ের জুতো অমিত কুমারের কাছ থেকে চেয়ে এনে
বাড়িতে রেখেছেন । আজও গানের জলসায় বেরনোর আগে তিনি সেই জুতোয় মাথা ঠেকিয়ে তবে বেরন
।
ও হ্যাঁ কুনালের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ অফিস আসার পথে কুনালের সাথে দেখা হল
ট্রেনে । ধোপদুরস্ত সাদা পাজামা পাঞ্জাবীতে আজ কুণালকে খুব সপ্রতিভ লাগছিল
অন্যদিনের থেকে । ‘আজ দাদা কোন গান গাইব
না, আজ ছুটি, মেয়ে বউকে নিয়ে এখন টালিগঞ্জ যাচ্ছি’। একটু অবাক হলাম, বোকার মত জিজ্ঞেস করলাম ‘কেন ভাই আজ কি কোন বিয়েবাড়ি টিয়েবাড়ি’ ? কুনাল একগাল হেসে বলল, ‘দাদা আজকের
তারিখটা ভুলে গেলেন ? আজ ৪ঠা আগস্ট, গুরুর জন্মদিন, তাই ফুল ও মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছি,
গুরুর মূর্তির সামনে রাখব । আর এই বছর মেয়ে বউকেও সাথে নিয়েছি ওরা কোনদিন গুরুর মূর্তি দেখেনি টালিগঞ্জ-এ’
। পাশে এক মহিলার মুখে দেখলাম তাঁর স্বামীর পাগলামির মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি । একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল । মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে বেরিয়ে গেল ‘ সাবধানে
যেও কুনাল’ । ঠিক এই সময় আমাদের আর এক সহযাত্রীর মোবাইল-এর রিংটোন বেজে উঠলো কুমার
শানুর একটি গান ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার, তোমাকে জানাই প্রনাম’ ।
ঋণস্বীকারঃ - বর্তমান সংবাদপত্র,
ফিল্মফেয়ার পত্রিকা, আনন্দলোক ও ইন্টারনেট থেকে সমস্ত ছবি প্রাপ্ত । ফিচারটিতে ব্যবহ্রিত
কুনাল দাস চরিত্রটি কাল্পনিক । বিশেষ কোন ব্যাক্তির সঙ্গে মিল থাকলে তা নিতান্তই
কাকতালীয় ।