Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

হারিয়ে যাওয়া সিনেমা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২১

হারিয়ে যাওয়া সিনেমা

 

আশাপূর্ণার কালো মেয়ের গল্প


আমাদের ছোটবেলাটা ছিল স্যাটেলাইট টিভি বর্জিত সময়। ৮০-এর দশকে বিনোদন বলতে ছিল রেডিও ও কোলকাতা দূরদর্শন-এর মাত্র একটি কি দুটি চ্যানেল। তখন চারিদিকে রঙিন টিভি আসলেও আমাদের বাড়ীতে সাদা-কালো টিভিতে নীল কাঁচ লাগিয়ে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখতে নেহাত মন্দ লাগত না। রবিবার সকালে যখন রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ন’ অথবা বি আর চোপরা-র  ‘মহাভারত’ হত তখন রাস্তায় বেরোলে মনে হত যেন কার্ফু লেগেছে, সবার চোখ তখন টি ভি-র পর্দায়। প্রতি শনিবার সন্ধ্যেয় টিভিতে বাংলা ছবি দেখার জন্য মা সব কাজ বিকেলের মধ্যেই সেরে নিত।  আমি আর দাদা কোন কোন সময়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে যেতাম বাংলা সিনেমা দেখতে।  কি অসাধারণ সব ছবি সেই সময় দূরদর্শন সম্প্রচার করত। সাড়ে চুয়াত্তর, মৌচাক, ধন্যি মেয়ে, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে আরও কত কি।  সেই সময় দেখেছিলাম এমন একটা বাংলা ছবি যার গল্প আজও ভুলতে পারিনি।  ছবিটি ছিল পরিচালক পার্থ প্রতিম চৌধুরী-র প্রথম ছবি ‘ছায়াসূর্য’।  

ছায়াসূর্য ছবির পোস্টার

এরপর বিভিন্ন সময়ে যখনই কাগজে দেখেছি ছবিটি আবার টি ভি-তে কোন একটি চ্যানেলে দেখানো হবে তখনই চেষ্টা করেছি আরও একবার দেখবার।  সম্প্রতি একটি অনলাইন প্লাটফর্মে এই কালজয়ী বাংলা সিনেমাটা দেখার আর লোভ সামলাতে পারলাম না, টানা দুঘণ্টা যে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। যখন কম্পিউটার শাট ডাউন করছি তখনও মনটা একরকমের হ্যাং ওভারে পরিপূর্ণ।  

      

ছবিতে ভি বালসারার মিউজিক্যাল স্কোর ছিল অসাধারন
১৯৬৩ সালে রিলিজ হওয়া এই ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন পাহাড়ী সান্যাল, মলিনা দেবী, বিকাশ রায়, অনুভা গুপ্ত, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণী ঘোষ, আরতি গাঙ্গুলি, নির্মল কুমার, শর্মিলা ঠাকুর প্রমুখ শিল্পীগণ। এছাড়াও বিভিন্ন ক্যামিও চরিত্রে ছিলেন চারুপ্রকাশ ঘোষ, রবি ঘোষ এবং জ্ঞানেশ মুখার্জি। গল্পের কাহিনী খ্যাতনামা সাহিত্যিকা আশাপূর্ণা দেবী।  ছবিতে অসাধারণ মিউজিক্যাল স্কোর করেছিলেন ভি বালসারা।

আশাপূর্ণা দেবীর লেখনীর সাথে যারা পরিচিত তারাই জানেন যে তাঁর গল্পের মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদী নারী। শুধু গল্প কেন, আশাপূর্ণার লেখা উপন্যাসও এর ব্যাতিক্রম নয়, তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ এবং ‘বকুলকথা’ উপন্যাসের কথা কে না জানে।  তাঁর গল্পের মেয়েরা যেন পাশের বাড়ীর মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে। ঘরোয়া অসহায় মেয়েদের নিয়ে তিনি লিখে গেছেন একএকটি কালজয়ী ছোটগল্প, যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সীমারেখার সীমা, তাসের ঘর, পৃথিবী চিরন্তনী, জালিয়াত, শাস্তি, ছিন্নমস্তা, অনাচার ইত্যাদি সব কালজয়ী গল্প যার মূল বিষয়ই হোল তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজের কিছু মান্ধাতা সিস্টেমের বিরুদ্ধে মেয়েদের প্রতিবাদ। এই ‘ছায়াসূর্য’ গল্পটাও ছিল অনেকটা ঠিক সেই রকম। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল একটি

লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী
কালো, কুৎসিত, দুরন্ত, সরল, মারকুটে, ঝগড়ুটে মেয়েকে নিয়ে,যার কথায় কথায় খই ফুটত সারাক্ষণ, পড়াশোনায় লবডঙ্কা । বছর বছর খালি ক্লাসে ফেল করে এবং খেলে বেড়ায় পাড়া-বেপাড়ার যত বখাটে ছেলেদের সঙ্গে । একমাত্র নিজের ছোটকাকা ছাড়া একান্নবর্তী পরিবারে কেউ তাকে দেখতে পারত না । উঠতে বসতে খোঁটা জুটত সবসময় সবার কাছ থেকে ।  কিন্তু ওর নিজের দিদি ছিল ওর থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। সুন্দরী, রুচিসম্পন্না, পড়াশোনায় দারুণ, সবার খুব প্রিয়পাত্রী। বাবা-মা-আত্মীয়দের কত গর্ব তাঁকে নিয়ে । দিদির নাম ছিল চেহারার সঙ্গে একেবারে মানানসই, ‘মল্লিকা’। কালো মেয়েটি, মানে বোনকে সবাই ডাকতঘেঁটু’ বলে । নামকরনের মধ্যেই যেন একটা অবজ্ঞা মিশে, আসলে বাংলায় ঘেঁটু ফুল তো সবচেয়ে উপেক্ষিত ফুলের মধ্যে একটা । কিছুদিন আগেই খবরের কাগজের শ্রুতি দাস নামে এক সিরিয়াল অভিনেত্রীর কথা পড়ছিলাম, যিনি পুলিশের কাছে একটি এফ আই আর করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ কিছু লোক দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কৃষ্ণবর্ন নিয়ে তাঁকে অত্যন্ত নোংরা ভাবে ট্রোল করার জন্য।  কাগজে রিপোর্টটা পড়ার সময় আরও একবার মনে পড়ল টেলিভিশনের পর্দায় দেখা ঘেঁটুকে।  

 

১৯৫৭ সাল নাগাদ স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র পার্থপ্রতিম বন্ধু মনোজ মিত্র ও আরও কয়েকজন সহপাঠী মিলে তৈরি করেন বিখ্যাত নাটকের দল ‘সুন্দরম’। সেই সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি পার্থপ্রতিম গল্প লিখতেন ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন।  পাশাপাশি সিনেমা জগত তাঁকে যেন নিশির ডাকের মতো হাতছানি দিত।  সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী পার্থপ্রতিমকে মুগ্ধ করেছিল তাই তিনি স্থির করলেন তাঁর নতুন নাটকের দল ‘সুন্দরম’ এর প্রথম মঞ্চস্থ নাটক হবে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’। পঞ্চাশের দশকের ঠিক সেই সময় কলকাতায় রমরমিয়ে চলছে ‘বহুরুপী’-র পুতুলখেলা নাটক, উৎপল দত্ত করছেন ম্যাস্কিম গর্কির ‘নীচের মহল’ নাটক, বিজন ভট্টাচার্য করছেন ‘মরা চাঁদ’ নাটক আর এসবের মধ্যে সেই সময় ‘সুন্দরম’ গ্রুপের ‘পথের পাঁচালী’ নিঃসন্দেহে একটি দুঃসাহসিক কাজ।  কিন্তু সকলের আপত্তি কানে না তুলে পার্থপ্রতিম বিশ্বরুপা মঞ্চে কাশবনের মধ্যে দিয়ে লাইটের মাধ্যমে রেলগাড়ি ছোটালেন এবং তার সাথে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবির বেশ কিছু আইডিয়া প্রয়োগ করলেন মঞ্চে, নিজে দুর্দান্ত অভিনয় করা সত্বেও দর্শক  ‘সুন্দরম’ প্রথম প্রযোজনা নিল না কারণ তাঁদের মাথায় তখন মানিকবাবুর ‘পথের পাঁচালী’-র স্মৃতি টাটকা। এরপর আর বেশীদিন থিয়েটারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল না, মন দিলেন চিত্রনাট্য লেখা ও সিনেমার দিকে। তাঁর পরিচালিত সিনেমার সংখ্যা মাত্র আট হলেও প্রত্যেকটি সিনেমা বিশেষ পারদর্শিতার নিরদর্শন রাখে।  মাত্র ২৫ বছর বয়সে পার্থপ্রতিম ১৯৬৩ –তে ‘ছায়াসূর্য’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে তিনি উপহার দিয়েছেন ‘শুভা ও দেবতার গ্রাস’, ‘দোলনা’, ‘হংস মিথুন’, ‘যদুবংশ’, ‘শুভ কেমন আছো’, ‘রাজবধূ’, ‘পূজারিণী’ প্রভৃতি ছবি। এক একটা ছবি এক এক রকম স্টাইলের। বিমল করের কাহিনী অবলম্বনে তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘যদুবংশ’-তে ‘গনা-দা’ রুপী উত্তমকুমারকে ভোলার নয়।  যেহেতু তাঁর লেখার হাত ছিল খুব ভালো তাই নিজের সিনেমা ছাড়াও বেশ কিছু অন্য সিনেমার চিত্রনাট্যও তিনি লিখেছিলেন যেমন অজয় কর পরিচালিত ‘পরিনীতা’ ছবির চিত্রনাট্য তাঁরই লেখা।  অসিত সেন-এর বিখ্যাত ছবি সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘দীপ জ্বেলে যাই’–এর সহ পরিচালকের ভুমিকাতেও ছিলেন পার্থপ্রতিম   

 

এই এক আমার দোষ হচ্ছিল পরিচালক পার্থ প্রতিম চৌধুরী-র প্রথম ছবি ‘ছায়াসূর্য’ নিয়ে চলে গেলাম ওনার ফিল্মি কেরিয়ারে।   তা যা বলছিলাম ‘ছায়াসূর্য’-তে ঘেঁটুর

ঘেঁটুর ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর

ভুমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের আগেই শর্মিলা ঠাকুর করে ফেলেছিলেন পাঁচটি বাংলা ছবি তার মধ্যে দুটি ছবি ছিল সত্যজিৎ রায়ের (অপুর সংসার ও দেবী) এবং একটি ছিল তপন সিনহার ছবি ‘নির্জন সৈকতে’। এছাড়া আরও দুটি ছবি ছিল শেষ অঙ্ক (বিপরীতে উত্তমকুমার) ও বর্ণালী (বিপরীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)।  ছবিগুলি দেখার সময় থেকেই পার্থপ্রতিম মাথায় রেখেছিলেন তাঁর প্রথম ছবির প্রধান চরিত্র হবেন শর্মিলা ঠাকুর ।
কী অসামান্য অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক শর্মিলাকে ।  মেকআপ শিল্পী ফর্সা শর্মিলাকে ছবিতে পুরো কালো করে দিয়েছিলেন। গল্পতে ঘেঁটুর সারল্য, নিজের কালো রঙের জন্য প্রত্যেকের কাছে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের শিকার হওয়া, সব সময় নিজের সুন্দরী দিদির সঙ্গে তুলনা অথচ ঘেঁটুর ভিতরে যে একটা সুন্দর মন লুকিয়ে আছে, সে ভালোবাসে একটি বেকার চালচুলোহীন ছেলেকে এবং সেও তার দিদির মতো একটি সুন্দর সংসার পাততে চায় সেই প্রেমিকের সাথে।  অত বড় বিশাল বাড়িতে ঘেঁটুর নিজের লোক বলতে তার নিজের সাহিত্যিক ছোটকাকা। তিনিই একমাত্র পড়তে পারেন তার আদরের ভাইজি-র মনের ভাষা। অত বড় বিশাল বাড়িতে সকলের প্রচণ্ড অবহেলার মধ্যে ছোট থেকে তাকে স্নেহের আড়াল করে রাখতেন ঘেঁটুর এই কাকা আর এই চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন নির্মলকুমার।   ছবিতে হেমন্ত মুখার্জির গাওয়া একটি অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত এসো আমার ঘরে এসোগানের মাঝে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘেঁটুরুপী শর্মিলা এসে পৌঁছয় তার
ছোটকাকা নির্মলকুমারের অভিনয় ভোলার নয়

বেকার প্রেমিকের বাড়ী। ঘেঁটুর বেকার প্রেমিকের ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন থিয়েটারের খ্যাতনামা অভিনেতা অরুন মুখোপাধ্যায় কিন্তু তাকে পরিচালক পার্থপ্রতিম চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে ব্যাক ক্যামেরায় ধরেছিলেন।  যারাই এই সাদাকালো
সিনেমাটি দেখেছেন তারাই জানেন এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের কি অসাধারণ ব্যবহার হয়েছিল ছবিতে।  আরও একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল এই ছবিতে, ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে তুমি’, গেয়েছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এবং সুমিত্রা সেন।  ঘেঁটু বিকেল পাঁচটা বাজলেই সবকিছু ফেলে ছুটে যেত তার প্রেমিকের কাছে, মেসবাড়ীর একটি ভাঙ্গাচোরা ঘরে, যেখানে নিজের বাড়িতে সবার কাছে পাওয়া উপেক্ষা, যন্ত্রণা ছাপিয়ে জেগে উঠত এক মানসিক তৃপ্তি, টোলপড়া মুখ ভরে উঠত এক নিস্পাপ হাসিতে।   এর মাঝে এক সময় সে কাকার সঙ্গে রাঁচিতে বেড়াতে যায় কিছুদিনের জন্য এবং সেখানে আলাপ হয় গিরিজাবাবু নামে এক মজার লোকের সাথে যিনি দুইবেলা আসতেন ঘেঁটুর সাহিত্যিক কাকার কাছে তাঁর
ছোট্ট চরিত্র কিন্তু কি অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন রবি

লেখা গল্প শুনতে এবং গল্পের প্রতিটি লাইন শুনে মাথা নাড়তেন, “বাঃ অসাধারণ লেখা, দারুন দারুন, বহুত আচ্ছা” এইসব বলে, কিন্তু কলকাতায় ফেরার দিন স্টেশনমাস্টারের কাছে  জানা গেল গিরিজাবাবু বদ্ধ কালা, অর্থাৎ এতদিন নির্মলকুমার এক বদ্ধকালাকে গল্প শুনিয়ে এসেছেন আর সেটা জেনে কাকা-ভাইজি হেসে লুটোপুটি আর ঠিক এইসময় পার্থপ্রতিমের ক্যামেরা ফোকাস করে রেলস্টেশন-এ অনাহুতের মতো গুটিগুটি পায়ে আসা গিরিজাবাবুর উপর, ওফ কি অসাধারন করুন এক্সপ্রেশন, ধরা পড়ে যাওয়া গিরিজাবাবু রূপি রবি ঘোষের।  

 

ছবির শেষ পর্ব ছিল খুব করুন ।  আমার ব্যাক্তিগত বিচারে ছবির এই শেষ দৃশ্য আমার দেখা হিন্দি বাংলায় শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় জীবনের সবচাইতে সেরা দৃশ্য। অনেক আশা ছিল ঘেঁটুর প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে একটা সুখের সংসার পাতবে কারণ কার তার নিজের বাড়ীতে না ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার, একটা অতি সাধারন বি.এ. পাশ করা বেকার ছেলেকে কেউ জামাই হিসাবে মেনে নেবে না।  হতাশ প্রেমিককে ঘেঁটু সবসময় সান্ত্বনা দিত একটা চাকরী ঠিক জুটে যাবেই তার।  কিন্তু ঘেঁটুর সেই গরীব বি.এ. পাশ বেকার প্রেমিক মারা যায়।   তাঁর শেষকৃত্যের জন্য একটা পয়সাও ছিল না।  বাধ্য হয়ে ঘেঁটু বাড়ি থেকে মাত্র ১০০ টাকা চুরি করে এনে প্রেমিককে শ্মশানে দাহ করে এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে বাড়ী ফিরে তার কপালে জোটে চোর অপবাদ ও লাঞ্ছনা।

ছবির শেষ দৃশ্যে কাকার কাছে ভেঙ্গে পড়ে ঘেঁটু

 
সেদিন
আবার ঘটনাচক্রে ঘেঁটুর সুন্দরী দিদি মল্লিকার ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে বাড়ীতে।  প্রচুর লোক, কিন্তু কেউ বিধ্বস্ত ঘেঁটুর দিকে ফিরেও দেখছে না, ছোটকাকার কাছে ঘেঁটু বলে এটাই ভালো হোল ওমন একটা চালচুলোহীন ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করলে পরিবারের সবার মাথা হেট হয়ে যেত।  শেষে কাকার আদরের ভাইজি কাকার কাছে অনুরোধ করে, “আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে ছোটকাকা?, যে একটা ঘর চেয়েছিল।” ছবির একদম শেষ কয়েকটি ফ্রেমে দেখা যায় ঘেঁটু একটা রজনীগন্ধার স্টিক হাতে নিয়ে বাড়ীর গেটে চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর অপরদিকে তার দিদি মল্লিকার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে তার সদ্যবিবাহিত স্বামী। আজ এত বছর পর আবার সিনেমাটা যখন দেখলাম তখন ওই একটা সাধারন কালো মেয়েকে নিয়ে লেখিকা  আশাপূর্ণা দেবী ও পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর অসাধারণ মেলবন্ধন দেখে একরাশ মুগ্ধতা ও তার সাথে কিছুটা বিষণ্ণতায় মন ভরে গেল।  আজ মহাপঞ্চমী, সকল বাংলার সকল ঘেঁটুর ভালো হোক।    

পরের বছর শর্মিলা ঘেঁটু থেকে হয়ে গেলেন চম্পা চামেলি, কাশ্মীর কি কলি ছবিতে

 
ছায়াসূর্য’ মুক্তির ঠিক পরের বছর শর্মিলা করলেন তার প্রথম হিন্দিছবি কাশ্মীর কি কলি’, শাম্মি কাপুরের বিপরীতে। ছবিটি দেখার সময় ফর্সা টকটকে চম্পারূপি শর্মিলা ঠাকুরকে ঠিক মেলাতে পারছিলাম না আমার দেখা কালো ঘেঁটুর সাথে। সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে, প্রেক্ষাপটে, জনপ্রিয়তায়, আভিজাত্যে উৎরে গিয়েছিলেন শর্মিলা, অভিনয় মোটামুটি, আমার খুব একটা ভালো লাগেনি কাশ্মীর কি কলি’, তবে আশা ও মহ রফির গানগুলো ছিল ফাটাফাটি। 

শেষকথাঃ - অনেক খুঁজলাম পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর একটা ছবি কিন্তু হায় গুগুল আমাকে ওনার জায়গায় দেখাল পরিচালক প্রভাত রায়ের ছবি, কোন সহৃদয় ব্যাক্তির কাছে যদি ওনার ছবি থাকে তাহলে আমাকে অনুগ্রহ করে মেইল করে দেবেন এই লেখার সাথে ওনার একটা ছবি থাকা উচিত।    

ঋণস্বীকার ঃ- মনোজ মিত্রের সাক্ষাৎকার, রুপায়ন ভট্টাচার্য, এই সময় ও ছায়াসূর্য সিনেমা।   

 ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই কালজয়ী রবীন্দ্রসংগীত

 

প্রবীর মিত্র

১০/১০/২০২১ - সবাইকে শুভ পঞ্চমীর শুভেচ্ছা জানাই।  

 

সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২০

হারিয়ে যাওয়া সিনেমা

 

ভোলে বাবা পার করেগা


১৯৭৭ সালের ঘটনা, শ্রাবণ মাস, রেডিওতে অথবা শিবরাত্রির দিনে বিভিন্ন জায়গায় রেকর্ড প্লেয়ারে হঠাৎ বাজতে শুরু করল আরতি মুখোপাধ্যায়ের একটা সিগনেচার গান ‘বাঁক কাঁধে তুলে, তারকেশ্বরে চলে সতী জয়বাবা বলে, ভাগ্যে তার কি আছে, জানতে চায় সে বাবার(মহাদেব) কাছে’  ব্যাস সেই শুরু, তারপর থেকে ছেলে-বুড়ো, মেয়ে-বৌ, সবাই ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমায় দেখা সন্ধ্যা রায়ের স্টাইলে বাঁক কাঁধে তুলে তারকেশ্বর ট্রেকিং করা শুরু করল ।

বাবা তারকনাথ ছবির রেকর্ডের ফ্রন্ট ইনলে

সবার মনে একটা প্রশ্ন কি হবে আমার ভবিষ্যৎ ? একমাত্র বাবা বিশ্বনাথের কাছে হয়ত এর উত্তর আছে, তাই অতি কষ্ট করে পদব্রজে ভক্তরা দলবেঁধে আজও বিশেষ কিছু তিথিতে বাবার কাছে ধর্না দেন।  

 

অথচ মজার কথা ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমাটা রিলিজ হবার আগে পর্যন্ত কেউ নিজেদের ভবিষ্যৎ-এর মনস্কামনায় বাবার কাছে যাবার এতো ঘটা দেখা যায় নি ।  ১৯৭৭ সালে রিলিজ হওয়া পরিচালক অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের এই ‘বাবা তারকনাথ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সন্ধ্যা রায়, বিশ্বজিত, অনুপকুমার, গীতা দে, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বোম্বাইয়ের তৎকালীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুলোচনা চ্যাটার্জি ।   মূলত ভক্তিমূলক ছবি হলেও এর জনপ্রিয়তা তৎকালীন বঙ্গদেশের প্রায় অনেকের মধ্যে একটা ভক্তিভক্তি

রেকর্ডের ব্যাক ইনলে

গদগদভাব জাগাতে সক্ষম হয়েছিল । আমার মা ছিল বাংলা সিনেমার পোকা । উত্তম-সুচিত্রা অথবা সদ্যরিলিজ হওয়া অনেক সিনেমা দুপুরবেলার শো-তে মা দেখতে যেত বাবা অথবা আমাদের প্রতিবেশী মাসিমার সঙ্গে । ‘বাবা তারকনাথ’ দেখে মা একেবারে অভিভূত । পরে মায়ের কাছে এই সিনেমার অলৌকিক কিছু আজব কাণ্ডকারখানার কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল একদিন বাঁক কাঁধে নিয়ে তারকেশ্বরে যাব ঠিক সন্ধ্যা রায়ের স্টাইলে ।  অনেক পরে অবশ্য গিয়েছিলাম, তবে বাঁক কাঁধে নিয়ে নয়, নিছক ঘোরার উদ্দেশ্যে । ছবির গানগুলোও সাঙ্ঘাতিক হিট করেছিল । রেডিওতে প্রত্যেক সপ্তাহে ছায়াছবির অন্যান্য ছবির গানের পাশাপাশি ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমার একটা গান থাকতোই । তবে আমার শোনা সব থেকে বেশী বেজেছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের একটা গান ‘বাঁক কাঁধে তুলে’, মান্না দে-র ‘শিবশম্ভু ত্রিপুরারি’, আশা ভোঁসলের ‘তুমি সূর্য, তুমি চন্দ্র’ আর দ্বিজেন
মুখোপাধ্যায় ও অংশুমান রায়ের গাওয়া ‘বাঁক কাঁধে চলরে, জয় বাবা বলরে’ ।   গানের কথা লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও সুর দিয়েছিলেন নীতা সেন । অথচ গল্প ছিল অত্যন্ত সাদামাটা, একেবারে পারিবারিক ছবি । ভগবানের অস্তিত্ব আছে কি নেই এটাই হোল এই সিনেমার মোদ্দা কথা । ছবির নায়ক বিশ্বজিত ঘোর নাস্তিক, হিন্দুধর্মের কোনও আচারবিচারের তোয়াক্কা করে না।  বাইরের জুতো পরে খাবার ও ঠাকুরঘরে দুমদাম ঢুকে পড়ে । 
বাঁক কাঁধে অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়

নায়িকা সন্ধ্যা রায় আবার ঠিক এর বিপরীত ।  সিনেমার গল্পে তিনি খুব ছোট্ট থেকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু শিবপুজো করেন আর একদিন শিবলিঙ্গের সামনে বিভোর হয়ে গান গাওয়ার (‘তুমি‘তুমি সূর্য, তুমি চন্দ্র’ – আশা ভোঁসলে) সময় এক বিষধর সাপ তার বিশাল ফনা তুলে ছোবল মারতে ভুলে যায়, এমনই ছিল সেই গানের ভক্তিরস, যা মানুষ তো কোন ছার একটা অবলা প্রাণীকেও সম্মোহিত করে।  তারপর বিভিন্ন আজগুবি ঘটনার মধ্যে দিয়ে নায়িকা সন্ধ্যা রায় তার নায়ক বিশ্বজিতের মনে ঈশ্বর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে ।  ব্রতশক্তি ও পার্বণের মাহাত্ম্য ছবির হিরো অনুভব করে একেবারে ছবির শেষে । অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় বেশ কিছু ভক্তিমূলক ছবি করলেও এই 'বাবা তারকনাথ' ছবির মতো আর কোন ছবি তাঁকে এতটা জনপ্রিয়তা দিতে পারেনি বলে মনে হয়।   তবে এই ছবির মাধ্যমে গ্রামবাংলার প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা আজগুবি ধারনা জন্মে গিয়েছিল । কোন লোক যদি সাপের কামড় খায় তাহলে ব্রতশক্তির মাধ্যমে সেই সাপ আবার সেই ব্যাক্তির কাছে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে এবং নিজের উগরে দেয়া কড়া বিষ আবার তুলে নেয় নিজের শরীরে । 
সিনেমার সেই আজগুবি দৃশ্য  

আজও এই আজগুবি ধ্যানধারনার জন্য গ্রাম বাংলার বহু মানুষ সাপের কামড়ে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যায় আর অপেক্ষা করে কখন সেই সাপ এসে নিজের বিষ নিয়ে যাবে, যার ফলে প্রাণ হারায় বহু মানুষ ।               

এই সিনেমার সাঙ্ঘাতিক জনপ্রিয়তার উপর ভর করে, এই সিনেমার প্রযোজক কেদারনাথ আগরওয়াল এবার এর হিন্দি ভার্সন করার জন্য উদ্যোগী হলেন । ইতিমধ্যে ১৯৭৫ সাল নাগাদ এই প্রযোজক ‘জয় সন্তোষী মা’ নামক একটি বিখ্যাত ভক্তিমূলক ছবির যুক্ত ছিলেন । তাই সেই ছবির জনপ্রিয়তার কথা ভেবে  বোম্বাই-এর বিখ্যাত সিনেমা কোম্পানি ‘রাজশ্রী প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড’ এগিয়ে এল এই ছবির প্রচারে।   ১৯৮০ সালে ‘রাজশ্রী প্রোডাকশন’ ব্যানারে রিলিজ হল এই সিনেমার হিন্দি ভার্সন । ছবিতে অভিনেতা অভিনেত্রীরা সবাই এক থাকলেও গানে এল একটা বড় পরিবর্তন ।

বাবা তারকনাথ ছবির হিন্দি রেকর্ডের কভার

  
বাংলা ছবিতে গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার কিন্তু হিন্দি ছবির জন্য গান লিখলেন বিখ্যাত কবি প্রদীপ ।  লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া সেই বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গানটা মনে আছে ? ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো’, ১৯৬৩ সালে রিলিজ হওয়া এই গানের কথা লিখেছিলেন এই বিখ্যাত হিন্দিভাষী কবি ।  হিন্দি ভার্সন-এ  গানের সংখ্যাও বেশ কমে গেল, যেখানে বাংলা সিনেমায় ছিল মোট আটটি গান সেখানে হিন্দি ভার্সন-এ গানের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল মাত্র চারটিতে ।  বাংলায় গান গেয়েছিলেন মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, দ্বিজেন
মুখোপাধ্যায় ও অংশুমান রায় সেখানে হিন্দিতে গাইলেন আরতি মুখোপাধ্যায় ও ভুপিন্দর সিং ।  কিন্তু হায়, গল্প এক হওয়া সত্ত্বেও এবং ‘রাজশ্রী প্রোডাকশন হাউজ' পাশে থাকা সত্ত্বেও হিন্দিভাষী বাবা তারকনাথ একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল ।   হিন্দিভাষী লোকেরা এই গল্পটা ঠিক নিল না ।        

 

শেষ করার আগে একটা  তথ্য দিই । ‘বাবা তারকনাথ’ বাংলা সিনেমার জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ১৯৭৭ সালে আরও একটি রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছিল । পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের গঠন যা মুখ থুবড়ে পরেছিল সুদীর্ঘ ৩৪ বছর পর ।  শোনা যায়, সেই সময় ব্রিগেডে বামফ্রন্ট সমাবেশের চেয়েও কত শতগুন মানুষ উন্মাদের মতো বাবার ধামে যাত্রা করত চৈত্র থেকে শ্রাবণ মাস। শ্রাবণ মাস আবার বাবা ভোলানাথের জন্মমাস ও বিয়ের মাস । বলা বাহুল্য এই

১৯৭৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছেন জ্যোতি বসু

শ্রাবনমাসেই বাবার ধামে সর্বাধিক জনজোয়ারে বামফ্রন্টের সন্তান থেকে ধরে অন্যান্য সব ডান, আধা ডান-বাম, আঁকাবাঁকা দলের সন্তানগণও সামিল হতে শুরু করে ।  তৎকালীন  নেতারা বোঝাতে শুরু করেন বাবার কাছে তার সব সন্তানই সমান, অথবা এই বাবা যেহেতু দাতা-ত্রাতা এবং রাগী বাবা তাই যাবতীয় দলাদল একেবারে তলাতল । কিছু না হোক – ভোলানাথ ষাঁড় আছে না ! একবার যদি গুঁতিয়ে দেয় তাহলে আর রক্ষা নেই ।   তাই সবাই মিলে বল “ভোলে বাবা পার করেগা”।

 

                                                               ছবির সেই বিখ্যাত গান 

প্রবীর মিত্র

৩০/১১/২০২০

তথ্যসূত্র ঃ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত সন্ধ্যা রায়ের সাক্ষাৎকার, উল্টোরথ ও সমস্ত ছবি ইন্টারনেট ও ইউটিউব হতে প্রাপ্ত।