।।হেমন্তকালের ১০০ বছর ।।
প্রবীর মিত্র
[ নামে হেমন্ত হলেও কণ্ঠে
তিনি চিরবসন্ত । আজ তিনি শতবর্ষে । মৃত্যুর ৩০ বছর পর আজও হেমন্ত কণ্ঠের অজস্র মন পাগল করা
বাংলা ও হিন্দি গানের সুর আকাশে রামধনুর মতো সাতরঙ ছড়ায় । গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতো
চেষ্টা করলাম তার সঙ্গীত জীবনের কিছুটা আলোকপাত করতে এবং তার সাথে চেষ্টা করব এই
লেখায় ব্যবহৃত গানগুলির ইউটিউব লিংক দিতে । অবশ্যই লিংক-এ ক্লিক করে
শুনবেন হেমন্তকণ্ঠের জাদু। আজ প্রথম পর্ব । কেমন লাগলো জানালে খুব আনন্দ পাব । ]
ছোটবেলায় গল্পটা শুনেছিলাম আমার বাবার কাছে
। দক্ষিণ কলকাতার এক জলসায় হেমন্ত
মুখোপাধ্যায় প্রায় গোটা কুড়ি-ত্রিশটি বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে ক্লান্ত হয়ে স্টেজ
থেকে নামার সময় দেখলেন, সামনে একজন অশিতিপর বৃদ্ধা, আকুলভাবে হেমন্ত-এর হাতটা
জড়িয়ে ধরলেন । হেমন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলবে মা” ?
![]() |
রেওয়াজ করছেন হেমন্ত |
প্রবল শীতের রাতে বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
“বাবা আমি নাতির সঙ্গে সেই বনগাঁ থেকে
এসেছি শুধুমাত্র তোমার গান শুনবো বলে, আজ আমার মন ভরে গেল বাবা” । তোমার জন্য একটা জিনিস
আমি নিজে হাতে বানিয়ে এনেছি বাবা, এটা তুমি নিলে আমি খুব খুশী হব”। হেমন্তবাবু বৃদ্ধার দেয়া একটা ঠোঙা নিলেন এবং
দেখলেন তার ভিতর কতকগুলি নারকেল নাড়ু । বৃদ্ধা বললেন, “অবশ্যই খেও বাবা আর আজ তুমি
এতো গান গাইলে কিন্তু আমার সবচাইতে প্রিয় গানটি তুমি গাইলে না”। হেমন্তবাবু
বৃদ্ধার মাথায় হাত জিজ্ঞেস করলেন, “কোন গানের কথা বলছ মা”? বৃদ্ধা বললেন, “ওই যে, সেই বিখ্যাত গান তোমার,
বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই, তুমি আছো ঘুমোঘোরে, আমি চলে যাই” । মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, “আপনি একটু
বসুন”, এই বলে হেমন্তবাবু আবার মঞ্চে উঠলেন, এদিকে ততক্ষণে পরবর্তী শিল্পী মঞ্চে
অর্কেস্ট্রা সাজিয়ে ফেলেছেন । হেমন্তবাবু সেই শিল্পীকে নিচু গলায় কি যেন বললেন,
তারপর জলসার সমস্ত দর্শক দেখল, সেই শিল্পী সসন্মানে হেমন্তবাবুকে আবার স্টেজ ছেড়ে
নিচে নেমে গেলেন । হেমন্তবাবু এরপর মাইক্রোফোন-এ তাঁর বিখ্যাত ব্যারিটন ভয়েসে
বলে উঠলেন, “আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আর একটিমাত্র গান গাইবো তারপর আমার পরবর্তী
শিল্পী গাইবেন । আমার একজন মা এসেছেন আজ এই জলসায়, তিনি আমার একটি গান শুনতে
চেয়েছেন, আমি সেই গানটি গেয়েই চলে যাব” । তারপর সেই নারকেল নাড়ুর ঠোঙাটা দর্শকদের
দেখিয়ে ঘটনাটি বলে ঠোঙাটা মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, “আমি কি এতখানি ভালোবাসার যোগ্য”
? জলসায় তখন পিন ফেলা নিঃশব্দ বিরাজ করছে
। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে হেমন্তবাবুর কথা শুনছেন । এরপর হেমন্তবাবু শুরু করলেন ‘কুহক’ ছবিতে তাঁরই
সুরারোপিত কীর্তনআঙ্গিকের সেই বিখ্যাত গান, “বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই, তুমি
আছো ঘুমো ঘোরে, আমি চলে যাই” (https://www.youtube.com/watch?v=j2WIHCAIJc0 ) ।
১৯২০ সালের ১৬ ই জুন বেনারসের মামার বাড়ীতে
জন্মগ্রহণ করলেও হেমন্তর আদি নিবাস দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘বহরু’ গ্রামে । বিশ শতকের
দিকে এই পরিবার কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসেন ।
হেমন্তরা ছিলেন চার ভাই, এক বোন । বড়ভাই শক্তিদাস, মেজ হেমন্ত, সেজ
তারাজ্যোতি, যিনি নিজে একজন সুসাহিত্যিকও ছিলেন ও সর্ব কনিষ্ঠ হলেন অমল, যিনি তাঁর
বড়দা হেমন্তর অনুপ্রেরনায় কিছু গান রেকর্ড করেছিলেন এবং হেমন্তবাবুর গাওয়া ‘জীবনের
অনেকটা পথ একলা চলে এলাম’ (https://www.youtube.com/watch?v=N9dWqZ166iM) গানটি কিন্তু
অমলবাবু তাঁর বড়দার জন্য সুর করেছিলেন ।
ছোটবোন নীলিমাও সংগীত অনুরাগী ছিলেন ।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় |
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করে
যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেন হেমন্ত ।
পরিবারের স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর মনের মধ্যেও গেঁথে দেওয়া হয়েছিল বড় হয়ে
লেখাপড়া শিখে একটা চাকরি জুটিয়ে অচল সংসারের হাল ধরতে হবে । তাঁকে জীবন পুরের একজন লড়াকু পথিক হতে হবে । এর
পাশাপাশি তিনি চেষ্টা করছিলেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছোট গল্প ও প্রবন্ধ লিখে কিছু
রোজগার করতে । কিন্তু দেড় বছর পর তিনি
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিলেন এবং শুরু করলেন টাইপ ও শর্টহ্যান্ড শেখা । কবিবন্ধু সুভাষ হেমন্তকে নিয়ে বিভিন্ন রেকর্ড
কোম্পানিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন । কিন্তু
কেউই হেমন্তকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না । অনেকেই
দরজা থেকেই পত্রপাঠ বিদেয় করে দিতে লাগলেন । একজন রেকর্ড কম্পানিএর
কর্তা তো হেমন্তর মুখের উপর বলেই বসলেন , “বাছা তুমি গান ছাড়া আর সব কিছু কর
কিন্তু দয়া করে এই মিনমিনে গলা নিয়ে গান গাইতে এস না” । ভেঙ্গে পড়লেন হেমন্ত
। কিন্তু সুভাষ হাল ছাড়লেন না । তিনি যেন ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছেন হেমন্তকে
গানের জগতে প্রতিষ্ঠা করবেনই । ঘটনাচক্রে
একদিন একটি চায়ের আড্ডায় তাদের সঙ্গে আলাপ হল সঙ্গীত জগতের দুই ব্যাক্তিতের । একজন
সন্তোষ সেনগুপ্ত ও অপরজন শৈলেশ দত্তগুপ্ত যারা দুজনেই কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত
ছিলেন । খালি গলায় একটা গান শুনে
সন্তোষবাবু হেমন্তকে নির্বাচিত করলেন কলম্বিয়া কোম্পানির পরবর্তী রেকর্ডের জন্য । তারপর হেমন্তর জীবনে একটা নাটকীয় মোড় নিল
। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে বেরল বাঘছাপ্পা
মারা একটি ৭৮ স্পীডের কয়লার রেকর্ড । রেকর্ডের একপিঠে “জানিতে যদি গো তুমি” (https://www.youtube.com/watch?v=r-OEF9uY4B8 ) ও অপর পিঠে “বল গো মোরে” (https://www.youtube.com/watch?v=mrfbVKfnxi4 ) । দুটি গানই নরেশ্বর
ভট্টাচার্যের লেখা ও শৈলেশ দত্তগুপ্ত এর
সুর । রেকর্ড তো বেরল কিন্তু কিনবে কে ?
সেই সময় বাংলা গানের জগতে রাজ করছেন পঙ্কজ মল্লিক, কুমার শচীনদেব বর্মণ,
পাহাড়ি সান্যাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রমুখ বাঘা বাঘা শিল্পীবৃন্দ । কোন রেকর্ডের দোকান হেমন্তর রেকর্ড নিতে রাজি
হল না । অগত্যা নিজের রেকর্ডের কিছু কপি
খবরের কাগজে মুড়ে হেমন্ত বিভিন্ন পরিচিতের বাড়ী যেতে শুরু করলেন । লাজুক হেমন্ত প্রথমে সেই পরিচিতিগণের বাড়ীতে
গিয়ে একগ্লাস জল চাইতেন । লোকে দেখে জানতে চাইতেন হাতে ওটা কিসের মোড়ক । সলজ্জ হেমন্ত বলতেন, “ও কিছু না এটা একটা
রেকর্ড । কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে বেরিয়েছে ।
আমার গানের রেকর্ড”। তখন বাড়ির
কর্তা হয়ত বলতেন, “ওমা তাই নাকি, এক কপি দাও দেখি, শুনে দেখব কত বড় গায়ক হয়েছ
তুমি” ? এইভাবে আস্তে আস্তে পরিচিত হতে লাগলেন হেমন্ত । ভাবুন তো একবার সেই সময় যদি ইউটিউব বা সোশ্যাল
মিডিয়া থাকতো তাহলে হেমন্তকে লোকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে নিজের রেকর্ড শোনানের জন্য
তদ্বির করতে হত না । মাউসের একটা ক্লিকেই কেল্লা ফতে হয়ে যেত ।
কুমার শচীন দেববর্মণ ও পঙ্কজ মল্লিকের গানের
অন্ধ ভক্ত ছিলেন হেমন্ত । গানের সময় ওনাদের বিশেষত পঙ্কজ মল্লিকের গায়কী ধরন
হেমন্ত কিছুটা অনুসরন করতেন । এর জন্য ওনাকে কেউ কেউ জুনিয়র পঙ্কজ বলে ডাকতে শুরু
করলেন । পাড়ার লোকেদের হাতে পায়ে ধরে বিভিন্ন ক্লাব ও অফিসে একটা কি দুটো গান
গাইবার সুযোগ পেতে লাগলেন । এর পাশাপাশি শুরু হল ট্রামে চেপে কলকাতার বিভিন্ন
জায়গায় গিয়ে লোকের বাড়ী বাড়ী গান শেখানো । লোকের কাছে জুনিয়র পঙ্কজ কথাটা শুনতে
খুব ভালো লাগতো । কিন্তু নিদারুন অভাব ও
দারিদ্র যেন তাঁর নিত্যসঙ্গী এসবে তো আর পেট ভরে না । একদিন হেমন্তর জীবনে একটা ঘটনা ঘটল । একটি
অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি ।
একটু আগে গিয়ে বসে আছেন । একে একে
অনেকেই গান গাইলেন ওই অনুষ্ঠানে । কিন্তু হেমন্তকে কেউ ডাকে না গান গাইবার জন্য
। এবার তিনি ধৈর্য হারিয়ে এগিয়ে গেলেন
গ্রিন রুমের দিকে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য । কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন কর্মকর্তারা একজনকে
খুব খাতির করছেন । তিনি আর কেউই নন স্বয়ং
হেমন্তর আইডল পঙ্কজ কুমার মল্লিক ।
হেমন্ত শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে একজন কর্মকর্তা কে বলে বসলেন, “আমি অনেকক্ষণ
অপেক্ষা করছি । এবার আমাকে মঞ্চ এ গান গাইবার ব্যবস্থা করে দিন” । বিরক্ত হয়ে কর্মকর্তাটি খিঁচিয়ে উঠলেন , “দূর
মশাই, স্বয়ং পঙ্কজ কুমার মল্লিক যেখানে এসে গেছেন সেখানে আপনার মত জুনিয়র
আর্টিস্টের গান কে শুনবে” ? খুব আঘাত পেলেন
হেমন্ত । না সেই অনুষ্ঠানে সেদিন আর গান গাওয়া হয়ে উঠেনি হেমন্তর তবে একটা জিনিস
সেদিন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, লোকে তাঁকে যতই
জুনিয়র পঙ্কজ বলুক না কেন, আসল পঙ্কজের কাছে তিনি নেহাতই শিশু । সেইদিনই
সিদ্ধান্ত নিলেন, মুছে ফেলতে হবে জুনিয়র
পঙ্কজ তকমা । সৃষ্টি করতে হবে তাঁর নিজস্ব স্টাইল।
ইতিমধ্যে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে হেমন্তর আরও
কয়েকটি রেকর্ড বেরিয়েছে । তবে এবার হেমন্ত
আর আগের মত ভুল করলেন না । হেমন্ত নিজের স্বাভাবিক গলাকে ব্যবহার করলেন তাঁর আগামী
রেকর্ডিং এ । “রজনীগন্ধা ঘুমাও ঘুমাও/চাঁদের স্মরিয়া শিউলি”, এই গানের মাধ্যমে
হেমন্ত তাঁর কণ্ঠস্বরে নিজেকে বের করে আনলেন । তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব গায়কী
স্টাইল ।
১৯৪০ সালে অজয় ভট্টাচার্য –এর কাহিনী অবলম্বনে
পরিচালক ফনী বর্মা করছিলেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নামক একটি ছবি । ছবিতে নামভূমিকায় ছিলেন দাপুটে অভিনেতা ছবি
বিশ্বাস । ছবি বিশ্বাসের জন্য প্লেব্যাক
করলেন হেমন্ত অনেক অবহেলা, অপমান সহ্য করে । ওই ছবির ‘পন্থা দেখাল ঝঞ্ঝা বাজালো
বাঁশী’ এই গানের মাধ্যমে হেমন্তর বাংলাছবির জগতে অভিষেক ঘটল (https://www.youtube.com/watch?v=-tt6UNsO9RU) । অবশ্য প্লেব্যাক গাইয়ে
হিসেবে প্রতাপশালী হয়ে হেমন্তকে আর বেশ
কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল ।
নিউ থিয়েটরসের ব্যানারে ১৯৪২ সালে মধু বসু
‘মীনাক্ষী’ নামক একটি হিন্দি ছবির পরিচালনায় হাত দিয়েছিলেন । পঙ্কজ মল্লিক ছিলেন
সেই ছবির মিউজিক ডিরেক্টর । আর পঙ্কজবাবু ছিলেন সেই সময়ের বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র
সঙ্গীতের একজন হোমরা চোমরা ব্যক্তিত্ব ।
কলম্বিয়া রেকর্ডের কর্ণধার শৈলেশ
দত্তগুপ্ত আলাপ করিয়ে দিলেন পঙ্কজ মল্লিকের সাথে তরুন হেমন্তর । রিহার্সাল রুমে হেমন্ত খালি গলায় একটি গান গেয়ে শোনালেন
তাঁর আইডল পঙ্কজবাবুকে । সেইদিন পঙ্কজবাবুর জহুরীর চোখ চিনে নিয়েছিল এই তরুন
যুবকের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক সম্ভাবনা ।
হেমন্ত সুযোগ পেলেন ‘মীনাক্ষী’
ছবিতে একটি হিন্দি গান গাইবার ।
ইতিমধ্যে শৈলেশ দত্তগুপ্ত-এর উদ্যোগে ও
তত্বাবধানে শুরু হল হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া । আর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র এর ভাই সৈামেন মিত্র পরিচালিত ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে
‘পথের শেষ কোথায়’ এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি গেয়ে হেমন্ত রীতিমত হৈচৈ ফেলে দিলেন । ১৯৪৬
সালে ‘সাত নম্বর বাড়ী’ ছবিতে সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে প্রনব রায়ের লেখা গান
‘ফেলে আসা দিনগুলি মোর’ (https://www.youtube.com/watch?v=qYlZXvWzWvI ) গানটি হেমন্তকে এনে
দেয় প্লে-ব্যাক আর্টিস্টের প্রতিষ্ঠা ।
এরপর ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে ‘স্মরণের এই বালুকাবেলায় চরণচিহ্ন আঁকি’ (https://www.youtube.com/watch?v=Tj6pBGzJbd0) গেয়ে হেমন্ত পাকাপাকি আসন
করে নিলেন বাংলা ছায়াছবির গানে । ওই বছরই দুটি হিট ছবি ‘নাই নাই ভয়’ এবং
‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘অয়ি ভুবনমোহনমোহিনী’ গান
দুটি গাইবার সুত্রে হেমন্ত-কণ্ঠ সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠতে থাকে ।
এরপর বিভিন্ন ছবিতে নেপথ্যে গান গাইবার জন্য
ডাক আসতে থাকল হেমন্তর এর পাশাপাশি বিভিন্ন জলসা তো আছেই । একদিন হেমন্ত জলসাতে কিছুক্ষনের সময়ের জন্য গান
গাইবার জন্য জলসার কর্তাব্যাক্তিদের হাতে পায়ে ধরতেন কিন্তু এখন ওনারা হেমন্তর
হাতে পায়ে ধরেন তাঁদের অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য । অত্যাধিক ভদ্র নম্র স্বভাবের হেমন্ত
ফেরাতে পারেন না তাদের । নিজের ব্যস্ত সময়
থেকে কিছুটা সময় বার করে নিয়ে চেষ্টা করেন ওনাদের কথা রাখতে । কিন্তু হেমন্তর ভিতর সব সময় নতুন একটা কিছু
করার তাগিদ লেগেই থাকতো ।
অবশেষে সুযোগ এল ১৯৪৭ সালে । সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত তাঁর যাত্রা শুরু
করলেন ‘অভিযাত্রী’ ও ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে । প্রায় চারমাসের ব্যবধানে মুক্তি পেয়েছিল
ছবি দুটি । এরপরেই হেমেন গুপ্ত পরিচালিত
‘ভুলি নাই’ ছবিতে অসাধারন কিছু মিউজিক কমপোজ করলেন । ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ৪২, দিনের পর দিন, স্বামী
এবং ১৯৫১ সালে হেমন্ত মাইলফলক মিউজিক তৈরি করলেন পরিচালক অজয় কর পরিচালিত
‘জিঘাংসা’ ছবির জন্য । ওই ছবিতে গা ছমছম করা আবহসঙ্গীতের সুত্রে প্রশংসা অর্জন
করেছিলেন হেমন্ত । এই ছবির একটি গান ছিল ‘আমি আঁধার আমি ছায়া’ গানটির সুর তিনি পরে
ব্যবহার করেছিলেন ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিতে, যেখানে তিনি লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে উপহার
দিয়েছিলেন ‘কহি দীপ জ্বলে কহি দিল’ (https://www.youtube.com/watch?v=c1tXbULiwx8 ) । দুটোগানই এক কথায় সুপারহিট । ঠিক এই রকমই গা ছমছম করা আর একটা গানের সুর
১৯৭১ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন তরুন মজুমদারের ‘কুহেলি’ ছবির জন্য । মনে পড়ে লতা
মঙ্গেশকরের সেই হৃদয় বিদারক গান ‘কে জেগে আছো, শুনেছ কি তার পায়ের আওয়াজ’ (https://www.youtube.com/watch?v=2Av1YCR1h6o ) । কি অসাধারন সুর করেছিলেন
হেমন্ত ।
সময় পেলেই হেমন্ত বসে যেতেন খাতা পেন নিয়ে আর বেরিয়ে আসত ছোট গল্পের প্লট |
রেকর্ডিং-এর দিন তার চিরচারিত পোশাক হাতাগোটানো
সাদা শার্ট ও ধুতি পরে হেমন্ত ফিল্মিস্তান স্টুডিয়োতে আসতেই হেমেন গুপ্ত পরিচয়
করিয়ে দিলেন কর্ণধার শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্তর সাথে কথা বলে শশধরবাবু
বুঝলেন প্রথাগতগত ভাবে হেমন্ত কোনদিন কারও কাছে গান শেখেন নি, এমনকি রবীন্দ্রসংগীত
তাও নয় । কিন্তু স্বরলিপি ঘেঁটে নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন । একটা গান শুনে তিনি বুজলেন হেমেন কলকাতা থেকে
ভুল লোককে আনেন নি । হেমন্তর গলায় অদ্ভুত
একটা মাদকতা আছে । একে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট
করা যেতেই পারে । হারমনিয়ামে বেশ কয়েকটি
গানের সুর তিনি তৈরি করে ফেললেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে । সেই ছবিতেই ‘বন্দেমাতরম’ কবিতার একটা অসাধারন
সুর তৈরি করে ফেললেন । ঠিক হল গানটি লতা
মঙ্গেশকর গাইবেন । তখন লতার বেশ নামডাক হয়েছে । সুরকার নৌশাদের খুব পছন্দের
আর্টিস্ট ছিলেন লতা । তা যাই হোক রেকর্ডিং এর দিন লতা এলেন । হেমন্তর সামনে তিনি
যেন গানের বাধ্য ছাত্রী । খুব মন দিয়ে লতা
তাঁর প্রিয় হেমন্তদাদার কাছ থেকে গানটি তুললেন কিন্তু ফাইনাল টেকিং এর সময় ঘটল
একটা বিরক্তিকর পরিস্থিতি । পরিচালক হেমেন
গুপ্ত চাইছেন, ছবিতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিপ্লবীরা যাচ্ছেন । ঘোড়াগুলি ছুটছে আর
ঘোড়াদের পা ফেলার তালে তালে ‘বন্দেমাতরম’ –এর লাইনগুলো ‘সুজলাং সুফলাং’ এর রিদম
বের করে আনতে । লতা আপ্রাণ চেষ্টা করে
যাচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই যেন পরিচালক হেমেনবাবুর পছন্দ হচ্ছে না । হেমন্ত হেমেনবাবুকে বোজানোর চেষ্টা করলেন
সবকিছুইতো ঠিক আছে উনি যেভাবে লতাকে গানটা তুলিয়েছিলেন লতাতো সেইভাবেই গাইছে
। কিন্তু হেমেনবাবু নাছোড়বান্দা । হেমন্তর বিরক্তিভরা মুখ দেখে লতা অনুধাবন করলেন
ছবির পরিচালক ও সংগীত পরিচালকের মধ্যে বিবাদ আসন্ন । লতা ধীরস্থির গলায় বললেন, ‘কোই
বাত নেহি হেমন্তদা, আজ মেরা সব রেকর্ডিং ক্যান্সেল, আপ ফির টেক কিজিয়ে’। লতার
অসম্ভব ধৈর্য দেখে হেমন্ত অবাক হলেন । অবশেষে ২৩ তম টেকিং-এ হেমনবাবু গ্রিন
সিগন্যাল দিলেন । অর্থাৎ গান ওকে । সেই
শুরু, এরপর হেমন্ত-লতার মধ্যে একটা খুব সুন্দর দাদা-বোনের গড়ে ওঠে যা গানের জগতে
এক আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল । হেমন্তর সুরে লতা মঙ্গেসকরের কণ্ঠে অসাধারন কিছু
বাংলা-হিন্দি ফিল্মের গান, আধুনিক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত আমরা পেয়েছি পরবর্তীকালে ।
তবে সে গল্প আজ নয় আর একদিন ।
১৯৫২ সালে আনন্দমঠ রিলিজ করল । কিন্তু বেশীদিন
দর্শককে ধরে রাখতে পারলনা এই ছবি । কিন্তু হেমন্তর সুরারোপিত ‘বন্দেমাতরম’ গানটি
তখন সবার মুখে মুখে (https://www.youtube.com/watch?v=xj1Iy4nRMkc) । শশধরবাবু হেমন্তকে একটা
চাকরীর অফার দিলেন তাঁর ফিল্মিস্তান স্টুডিয়োতে । রোজ সকাল দশটা থেকে পাঁচটা
পর্যন্ত হেমন্ত হারমনিয়াম নিয়ে শুধুমাত্র সুরসৃষ্টি করে যাবেন । কি মজার চাকরি তাই
না । এরপর শশধরবাবু ‘শর্ত’ নামে একটি ছবির
কাজে হাত দিলেন । হিরোর লিপে হেমন্ত তৈরি করলেন ‘না ইয়ে চাঁদ হোগা না পারে রাহেগি’
(https://www.youtube.com/watch?v=AfpMM6O1qsc) । কিন্তু এটাও বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ল । এরপর ‘সম্রাট’
ছবিটাও তেমন ব্যবসায়িক সাফল্য আনতে পারল না । হেমন্ত বুজলেন এইবার মুম্বাই-এর বাস
উঠাতে হবে । এইভাবে মাইনে নেওয়া তার পক্ষে
পোষাবে না । তিনি একদিন তাঁর বস শশধরবাবুর সাথে দেখা করলেন এবং কলকাতায় ফিরে যাবার
কথা বললেন । শশধরবাবু বুজলেন হেমন্ত হতাশার স্বীকার । তিনি হেমন্তর পদত্যাগ পত্রটা ছিঁড়ে ফেলে বললেন,
“দেখ ভাই, আমি তোমাকে এখানে এতদিন মাইনে করে রেখেছি মানে তোমার এমন কিছু একটা আছে
যেটা আমি বুঝি এবং জানি তাই তুমি আর কটা দিন দেখ,
‘নাগিন’ বলে একটি ছবির কথা আমি ভাবছি ।
আমি চাই ওই ছবির সংগীতের কথা তুমিও ভাব। ছবির গল্পটা আমি তোমার ঘরে পাঠিয়ে
দিচ্ছি । তুমি আজ বাড়ি ফিরে গল্পটা পড়ে কাল থেকেই তুমি এর মিউজিক বানানোর কাজে
লেগে যাও”। শশধরবাবুর ব্যক্তিত্বপূর্ণ
কণ্ঠস্বরের কাছে হেমন্ত একেবারে মিইয়ে গেলেন । চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলেন ।
সেদিন রাতে গল্পটি পড়ার পর, পরদিন অফিসে গিয়ে
হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন। এই ছবিতে নতুন একটা কিছু করতে হবে। না হলে তিনি শশধরবাবুর
কাছে আর মুখ দেখাতে পারবেন না । সেইদিন দুপুরে শশধরবাবু এক গুজরাতি যুবককে নিয়ে
এলেন হেমন্তর কাছে । ছেলেটি নাকি
নানাধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে । বেশ কয়েকটি বাজনা শুনলেন হেমন্ত । তারপর হঠাত
‘ক্ল্যাভিওলিন’ নামক একটি বাদ্যযন্ত্র-এর আওয়াজ শুনেই হেমন্ত চমকে উঠলেন । আরে এটা
তো অলৌকিক যোগাযোগ । তিনি তো নাগিন ছবির জন্য এইরকম একটা মিউজিকই খুঁজছিলেন ।
সাপখেলা দেখানোর সময় সাপুড়েরা এক ধরনের বিন বাজায় সেই বিনের তালে তালে সাপ মাথা
নাড়ায় । বাংলায় একে অনেকে তুবড়ি বাঁশিও
বলে থাকেন অনেকে । কিছুটা সুর তিনি
হারমোনিয়ামে তুলে ছিলেন হেমন্ত । সেটা
ছেলেটিকে শোনালেন হেমন্ত । ছেলেটি তারপর
সেই সুরের অবিকল রূপ ‘ক্ল্যাভিওলিন’
যন্ত্রে বাজাতে লাগলেন । আবিস্কারের
আনন্দে হেমন্ত সেই ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন । সেই ছেলেটির নাম কল্যানজি বীরজি
শাহ । যিনি পরবর্তী কালে তাঁর ভাই আনন্দজির সাথে জোট বেঁধে বলিউড মিউজিক
ইন্ডাস্ট্রিতে ‘কল্যানজি-আনন্দজি’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন ।
অবশেষে ১৯৫৪ সালে নাগিন রিলিজ করল ।
প্রদীপকুমার ও বৈজন্তিমালা এই ছবির হিরো হিরোইন । সব মিলিয়ে এই ছবির জন্য হেমন্ত
১২ টি গান তৈরি করেছিলেন এবং কয়েকটি গান তিনি নিজে ও তাঁর ভগ্নীসম লতাকে দিয়ে
গাইয়েছিলেন ও তার সাথে তিনি কল্যানজির বাজানো সেই বিনের সুরটি ছবির বিভিন্ন জায়গায়
ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সিনেমাহলে নাকি সাপ ঢুকে
পড়েছে এমন সাংঘাতিক একটা গুজব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । সাপুড়ে প্রদীপকুমারের বিন
বাজানোর দৃশ্যে পর্দায় সাপ নেচে ওঠার পাশাপাশি বিনের শব্দে বুঁদ হয়ে নাগলোক থেকে
সমস্ত সর্পকুল নাকি হানা দিচ্ছে সিনেমাহলে ।
সিনেমাটি ও এর গানগুলি বাম্পারহিট । রেডিও স্টেশনগুলোতে নাগিন ছবির ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ (https://www.youtube.com/watch?v=cvOD8GZ7reo) ও ‘কাশী দেখি
মাথুরা দেখি’ (https://www.youtube.com/watch?v=DFb1dFmpLyY) গানগুলো ও বিনের
সুর বাজতে লাগলো । মুম্বাইবাসীর কাছে
তখন হেমন্ত শুধুমাত্র মিউজিক ডাইরেক্টর হেমন্ত কুমার । ১৯৫৬ সালে ‘নাগিন’ ছবির জন্য হেমন্ত পেলেন
‘ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার’ বেষ্ট মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে ।
‘নাগিন’ সুপার হিট হবার পর হেমন্ত –এর কাছে
বিভিন্ন ছবির জন্য মিউজিক তৈরির জন্য ডাক আসতে লাগলো । ‘জাগৃতি’ (১৯৫৪), বিস সাল বাদ (১৯৬২), খামোশী
(১৯৬৯) ইত্যাদি হিন্দি ছবিতে তাঁর সংগীতসৃষ্টি ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চিরকাল
মনে রাখবে ।
একদিন কলকাতা থেকে পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়
এলেন হেমন্তর মুম্বাই এর বাড়িতে । তিনি একটি ছবি করছেন উত্তম কুমার ও সুচিত্রা
সেনকে নিয়ে । ছবির নাম ‘শাপমোচন’ । তিনি চান ওই ছবিতে হেমন্তবাবু সুরারোপ
করুক । কিন্তু হেমন্তর হাতে তখন অনেকগুলি
ছবির কাজ তাছাড়া শচীনকর্তার কয়েকবছর আগে তাঁর ‘জাল’ ছবিতে হেমন্তকে দিয়ে গাইয়ে
নিয়েছিলেন হিরো দেবানন্দের লিপে সেই বিখ্যাত গান ‘ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনি ফির কাঁহা’ (https://www.youtube.com/watch?v=dBw_JSiNF9c ) যেটি খুব হিট হবার পর শচীনকর্তা তাঁর আগামী ছবিগুলোতে তাঁর
সুরে গান গাইবার জন্য হেমন্তকে বুক করে রেখেছিলেন ।
শাপমোচন ১৯৫৫ সালের মে মাসে মুক্তি পেল । ছবির গানগুলো নিয়ে কোলকাতায় হুলুস্থূল পড়ে গেল (https://www.youtube.com/watch?v=MyZWsUwM0zU )। এই ছবিতেই উত্তমকুমারের জন্য হেমন্তর প্রথম প্লে ব্যাক । তখন একদিকে ‘নাগিন’ অন্যদিকে ‘শাপমোচন’ । দুটো ছবিই হেমন্তকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিল । সবাই তখন কলকাতায় বাংলা ছবির জন্য হেমন্তকে চাইছে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও প্লে-ব্যাক করার জন্য । এরপর ১৯৫৬ সালে আবার কোলকাতায় এসে করলেন ‘সূর্যমুখী’ ছবির সঙ্গীত । তারপর ১৯৫৭ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ালো তিনটি ছবিতে । ‘শেষ পরিচয়’, ‘তাসের ঘর’ এবং আর একটি উত্তম-সুচিত্রা জুটির আর একটি মাস্টারপিস ছবি ‘হারানো সুর’ । এই ‘হারানো সুর’ ছবির জন্য গানের রেকর্ডিং –এ একটা ঘটনা ঘটেছিল । সেটা বলব তবে আজ নয় আগামী পর্বে ।
আগামী পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন