সে আমার ছোট বোন,
বড় আদরের ছোট বোন
ঘটনার সময়কাল ১৯৭৭ সাল। উত্তর কোলকাতার মদন ঘোষ লেনের বাড়ীতে শিল্পী মান্না দে-র রেওয়াজ ঘরে বসে ১৭ বছরের তরুন সুপর্ণকান্তি ঘোষ। তার আগের বছরেই চলে গিয়েছেন বাবা কিংবদন্তী সুরকার নচিকেতা ঘোষ। সাংবাদিক অজয় বিশ্বাস ছিলেন সুরকার নচিকেতা ঘোষের প্রিয় বন্ধু ও প্রতিবেশী। নচিকেতাবাবু মারা যাবার পর যুবক সুপর্ণকান্তি বাবার হারমোনিয়াম নিয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ইত্যাদি গীতিকারের লেখায় সুর তুলতেন, যেগুলি তাঁর বাবা বাতিল করে দিয়েছিলেন। এটা তাঁর কাছে একটা শখের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। একদিন অজয়বাবু নচিকেতা ঘোষের বাড়ীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলেন কে যেন গান গাইছে। ঘরে ঢুকে দেখলেন হারমোনিয়াম নিয়ে একমনে গান গাইছেন নচিকেতা ঘোষের সুপুত্র। গান শুনে তো অজয়বাবু মুগ্ধ। এর কিছুদিন পর একই বিমানে বোম্বাই যাবার পথে মান্না দে-র সাথে অজয়বাবুর দেখা। একথা সেকথার পর অজয় বিশ্বাস জানালেন যুবক সুপর্ণকান্তির সুরসৃষ্টির কথা। মান্নাবাবু নচিকেতা ঘোষের ছেলে খোকাকে (সুপর্ণকান্তি ঘোষ-এর ডাকনাম) চিনতেন এবং খুব স্নেহও করতেন কারণ বেশ কিছু গানের রেকর্ডিংএ বাবার সঙ্গীত পরিচালনায় সুপর্ণকান্তি বংগো বাজাতেন, কিন্তু ও যে সুর করছে সেটা মান্নাবাবুর জানা ছিল না। কিছুদিন পর তিনি সুপর্ণকান্তিকে ডেকে পাঠান তাঁর উত্তর কোলকাতার বাড়ীতে। রেওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে মান্নাবাবু সুপর্ণকান্তির সঙ্গে আলাপচারিতা করছিলেন। নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন সুপর্ণকান্তিকে। বাবার মতো আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। সুপর্ণকান্তির নিজের সুরের কিছু গানও শুনলেন। বুঝলেন এই ছেলের দম আছে। গান শোনার পর সেইদিন মান্নাবাবু তাঁর আদরের খোকার হাতে তুলে দিলেন একটা খাম যার ভিতরে একটি চিরকুটে লেখা আছে একটা গানের কটা লাইন, যেটাতে সুর বসাতে দায়িত্ব দিলেন
![]() |
সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ |
স্বয়ং মান্না দে তার সাথে এটাও জানিয়ে দিলেন যে এই গান আরও একজন সুর করেছেন ইতিমধ্যে, যদি খোকার করা সুর মান্নাবাবুর পছন্দ হয় তাহলে তিনি পরের পুজোয় এই গান রেকর্ডিং করবেন। বেশ গুরুদায়িত্ব, কিন্তু সেইদিনই সুর বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেল মান্না দে-র উত্তর কোলকাতার বাড়ীর বাইরে বেরনোর সাথে সাথে। উত্তর কোলকাতার হেদুয়া থেকে দক্ষিণ কোলকাতার হাজরা মোড় যাবার পথে দোতলা ২বি বাসে চেপে বসলেন, সুপর্ণকান্তি। দুপুরবেলা, বাসের দোতলা মোটামুটি ফাঁকা। বুক পকেটে রাখা খাম থেকে চিরকুটটা ভালো করে চোখ বুলোতেই বুঝতে পারলেন হাতের লেখা বরেন্য গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়ের, কারণ বাবার সংগীত পরিচালনার দৌলতে উনি এই হাতের লেখার সাথে অনেকদিন আগেই পরিচিত।
‘মার স্নেহ কাকে বলে জানিনা,
বাবার মমতা কি বুঝতে না বুঝতে
এ বিরাট পৃথিবীতে দেখলাম
সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই
সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন’।
এই কটা লাইন বাসে বসেই গুনগুন করতে করতে সুর করে ফেললেন সুপর্ণকান্তি। বাড়ীতে এসেই হারমনিয়ামে তুলে নিলেন সুরটা। কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো গানের সুর রেডি। আবার সুপর্ণকান্তি এলেন তাঁর মানাকাকুর উত্তর কোলকাতার বাড়ীতে। মন দিয়ে গানের সুরারোপ শুনলেন মান্না দে। গানের শেষে ঘরে যেন পিন পড়ার শব্দ শুনতে পারা যাবে এমন নিস্তব্ধতা। সুপর্ণকান্তি লক্ষ্য করলেন তাঁর মানাকাকুর চোখে জল। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, “খোকা তোমার সুরের এই গান আমি গাইব”। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠা মান্নাবাবু তাঁর মা-এর পাশাপাশি একমাত্র বোন বীণাপানিকেও খুব ভালোবাসতেন। মা-কে নিয়ে অসংখ্য গান রয়েছে তাঁর কিন্তু বোনকে নিয়ে যে এমন গান হতে পারে তার সাথে এমন সুর, সব দিক থেকেই যেন একটু বৈচিত্র বহন করছে।
![]() |
'সে আমার ছোট বোন' গানের রেকর্ডিং-এ বামদিক থেকে গানের সুরকার সুপর্ণকান্তি, গায়ক মান্না দে ও গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় |
অবশেষে রেকর্ড হল ১৯৭৮ সালের পুজোর গান, পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ও সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুর করা মান্না দে-র সেই কালজয়ী গান, সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন’ যা সুরকার হিসাবে সুপর্ণকান্তি ঘোষকে প্রথম পরিচিতি এনে দিয়েছিল। এই গানের রেকর্ডের অপরপিঠে ছিল আরও একটি দুর্দান্ত গান, ‘এ নদী এমন নদী, জল চাই একটু যদি, দুহাত ভরে উষ্ণ বালুই দেয় আমাকে’, এই গানের কথাও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন কিন্তু সুর দিয়েছিলেন প্রভাস দে, সুপর্ণকান্তি নন।
অটল, তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন খোকার সুর ছাড়া এই গান তিনি গাইবেন না। গান রিলিজের পর এই গান সাংঘাতিক হিট হোল কিন্তু প্রচারবিমুখ সুপর্ণকান্তি সেভাবে পরিচিত হলেন না, আসলে তিনি মানুষটাই এমন, কারণ আর এক দাপুটে সুরকার নচিকেতা ঘোষের রক্ত বইছে তাঁর ধমনীতে তাই যেন তিনি নিজেকে একটু অভিমানের সঙ্গেই আড়াল রাখলেন। এর কয়েকবছর পর, সুপর্ণকান্তির মানাকাকা আবার ডাকলেন তাঁকে এবং এবার দিলেন পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা বিভিন্ন আঙ্গিকের সাত সাতটি গান এবং গানগুলোর সুর করার ভার দিলেন। ১৯৮০ সালে এইচ এম ভি থেকে রিলিজ হোল মান্না দে-এর ‘সারা জীবনের গান’ নামক একটি লং প্লে রেকর্ড।
প্রত্যেকটি গান একেবারে বাম্পার হিট। গানগুলির থিমও খুব মোহময়। মা, শৈশব, ভালোবাসা, যৌবন, পরিবার, জীবন এবং রেকর্ডের শেষ গান অবশ্যই আবার মা-কে নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখা ভালো, পুলকবাবুর গানের কথায় থাকত এক একটা সম্পর্কের ছবি। যেমন ভাইবোন-এর সম্পর্ক ছাড়াও বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে লেখা গান ‘আয় খুকু আয়’ (গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তি মজুমদার), মা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে লেখা গান ‘তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে’ (গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তি মজুমদার)। অবশ্য আমরা এর আগেই শুনে ফেলেছি, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই কালজয়ী গান, যেটারও থিম ছিল ভাই-বোনের সম্পর্ক, ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর, চাঁদ উঠেছে ওই’, কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচির কথায় এই গানের সুর দিয়েছিলেন, সুধীন দাশগুপ্ত।
সুপর্ণকান্তির একটা সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তাঁর মায়ের পরেই নিজের দুই ছোটবোন, শ্রাবণী ও সম্পূর্ণা সুপর্ণকান্তির জীবনে খুব বড় একটা ভূমিকা নিয়েছে। তাই জীবনের প্রথম গানটিই তিনি তাঁর দুই বোনকে উৎসর্গ করেছিলেন। আগেই বলেছি একমাত্র বোন বীণাপানিকেও খুব ভালোবাসতেন মান্না দে। তাই গানের মধ্যে দাদার, বোনের প্রতি আকুতি আজও গানটি শুনলে ধরা পড়ে কানে এবং পাশাপাশি চোখে জল এনে দেয়। স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসার এক অসামান্য মেলবন্ধন এই গানটি।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ- সুপর্ণকান্তি ঘোষের নানারকম সাক্ষাৎকার ও রুপায়ন ভট্টাচার্য (এই সময়)।
প্রবীর মিত্র
০৭/০২/২০২১