চেনা গানের অজানা কথা
সলিল চৌধুরী তাঁর প্রিয় তিন শিষ্যকে বেশ সুন্দর একটা নাম দিয়েছিলেন। ‘প্রবীরানলাভিজিত’। অর্থাৎ প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায় ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । তিন জনেই বাংলাগানের বিখ্যাত সুরকার। এঁদের মধ্যে অভিজিৎবাবু আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে একজন শ্রদ্ধেয় ও স্মরণীয় ব্যাক্তিত্ব। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। উনি আমার প্রিয় সঙ্গীত ব্যাক্তিত্বদের মধ্যে একজন। একসময় প্রচুর শ্রুতিমধুর আধুনিক ও ছায়াছবির বাংলা গান আমরা উপহার পেয়েছি ওনার কাছ থেকে । ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতার সুরারোপ এবং তারপর সলিল চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে অভিজিৎবাবুর সাংগীতিক যাত্রাপথের শুভারম্ভ। শ্যামল মিত্রের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি ছিল ‘ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা দেয় দুরপাল্লা’, যা আরও সমান জনপ্রিয়। আজ এই এপিসোডে সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরসৃষ্ট দুটি গানের রেকডিং-এর নেপথ্য কাহিনী আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আজ আবার বিশ্বসংগীত দিবস। সংগীতের সাথে যুক্ত সমস্ত কলাকুশলীদের এবং এই ব্লগের সমস্ত পাঠক পাঠিকাদের জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকবেন, ভালো গান শুনবেন ও অন্যদের শোনাবেন।
১৯৬৬ সালের ছবি ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’-তে অভিজিৎবাবুর প্রথম বাংলা ছায়াছবিতে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ এরপর ১৯৭২ সালে ‘ছায়াতীর’ ছবিতে সুরারোপ। ছবিদুটিতে ওনার সুরে গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন ও
![]() |
সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় |
গীতা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী। ১৯৭৪ সালে পরিচালক সলিল রায় ‘জীবন রহস্য’ নামক একটি থ্রিলার ছবির কাজ শুরু করলেন। বোম্বাই-এর ‘প্রাণ’ ছিলেন এই ছবির প্রান অর্থাৎ প্রধান চরিত্র। বালাই বাহুল্য এটিই ‘প্রাণ’ অভিনীত প্রথম বাংলা ছবি। ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার গুরুদ্বায়িত্ব পেলেন অভিজিৎবাবু। ছবিতে সর্বমোট চারটি গান। দুটি গান মান্না দে গাইবেন আর বাদবাকি দুটি গাইবেন আশা ভোঁসলে। মান্নাবাবুর গান ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখ, আমরা দুজনে কত সুখী’ এবং ‘কে তুমি শুধুই ডাক’ গানদুটি নির্বিঘ্নে রেকর্ডিং হয়ে গেল। মুস্কিল হোল আশাজির গানের রেকর্ডিং –এর সময়। আশাজী তখন বোম্বাই-এর প্রচণ্ড ব্যাস্ত একজন শিল্পী। সেই সময়কার প্রায় সবকটি হিন্দি ছবিতেই ওনার গান, এক একদিন প্রায় ৮/১০ টা রেকর্ডিং-এর কাজে উনি ব্যাস্ত থাকেন। এদিকে আবার একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটেছিল। কোলকাতার এক সঙ্গীত পরিচালকের আশাজীকে দেওয়া একটি চেক বাউন্স করে, তাই আশাজী একটু বিরক্তও ছিলেন মনে মনে কোলকাতার সঙ্গীত পরিচালকদের উপর। কোলকাতার সুরকারদের উপর আর বেশী ভরসা করতে পারছিলেন না। অবশেষে মান্না দে-র হস্তক্ষেপে আশাজীর কাছ থেকে জুন মাসের ৩ তারিখে একটা ডেট পাওয়া গেল।
![]() |
সিনেমার পোস্টার |
সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আগের মাসের শেষের দিকে একটু অ্যাডভান্সই বোম্বাই চলে গেলেন। রেকর্ডিং যেহেতু ৩ তারিখ তাই ব্যাস্ত আশাজীকে আগে সময় করে গানদুটিকে তোলাবেন। কিন্তু কয়েকদিন পরেই তিনি জানলেন উক্তদিনে আশাজী অভিজিৎবাবুর গান রেকর্ডিং করবেন না, অন্য কয়েকজন খ্যাতনামা সুরকারদের উনি সেইদিন সময় দিয়েছেন। সুতরাং আবার ডেট ফিক্সড হোল ১৩ তারিখে, তাও দুটো নয় মাত্র একটা গান গাইবেন তিনি। একটু মুষড়ে পরলেন অভিজিৎবাবু। ভাবলেন আর একটি গান কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই তিনি জানতে পারলেন ১৩ তারিখে আশাজী আরও সাতজন মিউজিক ডাইরেক্টরকে ডেট দিয়ে ফেলেছেন গান রেকর্ডিং-এ তার মধ্যে তাঁর স্বামী রাহুল দেব বর্মণও আছেন। হতাশ অভিজিৎবাবু যোগাযোগ করলেন মান্না দে-র সাথে, যিনি আশাজীর রেকর্ডিং-এর ডেটের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন। সবশুনে মান্নাবাবু আশ্বাস দিলেন অভিজিৎবাবুকে। ৯ তারিখ আশাজীর সাথে মান্না দে-র একটি হিন্দি ছবির গানের রেকর্ডিং আছে,
![]() |
মান্না দে |
সেদিন উনি সময়মতো অভিজিৎবাবুর গানের রেকর্ডিং-এর ব্যাপারে কথা বলবেন তাঁর সাথে। তিনি নিজে বাঙ্গালী তাই মান্নাবাবু এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। ৯ তারিখ রাতে অভিজিৎবাবুর হোটেলরুমে একটা ফোন এল। দূরভাষের ওপারে মান্না দে। ‘১৩ তারিখই রেকর্ডিং হবে, আপনি ঠিক আগের দিন সকাল দশটার আগে আশাজী-র বাড়ী ‘প্রভুকুঞ্জে’ চলে যাবেন এবং ওনাকে আপনার গানটি তুলিয়ে দেবেন’।
১২ তারিখ সকালে সময়মতো অভিজিৎবাবু ‘প্রভুকুঞ্জে’ পৌঁছালেন এবং ‘ও পাখী উড়ে আয়’ গানটি আশাজী-কে তুলিয়ে দিলেন। শ্যামকল্যান রাগের একটি খেয়ালের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই গান শিখে খুব খুশী হলেন আশাজী। অভিজিৎবাবুকে অনুরোধ করলেন অপর গানটিও শিখিয়ে দেবার জন্য। অন্য কোনদিন তিনি এই অপর
![]() |
আশা ভোঁসলে |
গানটি রেকর্ড করবেন। তখন অভিজিৎবাবু আশাজীকে ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’ গানটিও তুলে দিলেন। এটাও খুব ভালো লাগলো তাঁর। তৎক্ষণাৎ সেক্রেটারীকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘কাল সবার প্রথম আমি কোলকাতার এই ভদ্রলোকের গান রেকর্ড করব, তারপর পঞ্চম (রাহুল দেব বর্মণ) ও অন্যান্যদের গান’, সবাইকে ফোন করে বলে দাও’।
পরের দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ অভিজিৎবাবু খুব টেনশন নিয়ে স্টুডিয়োতে এলেন কারণ এটাই তাঁর সুরারোপিত প্রথম বোম্বাই-এর আর্টিস্ট নিয়ে গান রেকর্ডিং। এরপর মান্না দে-ও এসে হাজির হলেন অন্য একটি ছবির গানের রেকর্ডিং-এর সূত্রে । এবার অভিজিৎবাবু মনে একটু জোর পেলেন। নির্দিষ্ট সময়ে আশা ভোঁসলে স্টুডিয়োতে এসেই প্রথম রেকর্ড করলেন ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’। খুব ভালোভাবে রেকর্ডিং হোল। অভিজিৎবাবু তখন আশাজীকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন পরবর্তী গানের রেকর্ডিং-এর ডেটটা কবে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে। অভিজিৎবাবু ও মান্না দে-কে চমকে দিয়ে আশাজী বললেন, “অভিজিৎবাবু, আপনার প্রথম গানটি গেয়ে আমার মুড এসে গেছে, সেটা আর নষ্ট করতে চাই না। আপনি কি এক ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু মিউজিক আরেঞ্জ করতে পারবেন?’ হাতে স্বর্গ পেলেন অভিজিৎবাবু। সাধারণত একটা গানের রেকর্ডিং-এর পর সঙ্গীতায়োজনের সময়টুকুতে উনি রেকর্ডিং ফ্লোরে থাকেন না। কিন্তু সেদিন এর ব্যাতিক্রম হোল। মান্না দে পাশেই ছিলেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে, অভিজিৎবাবু, আপনি আর দেরি করবেন না এরপরই পঞ্চমের গানের রেকর্ডিং আছে, আপনি কাজে লেগে যান, ততক্ষন আমি আশাজীর সাথে একটু আড্ডা মেরে নিই”।
একঘণ্টার মধ্যে আবার রেকর্ডিং ফ্লোর রেডি করে নিলেন অভিজিৎবাবু এবং আশাজী রেকর্ড করলেন সেই ‘জীবনরহস্য’ ছবির সেই কালজয়ী গান ‘ও পাখী উড়ে আয়’। ছবিতে প্রত্যেকটি গান হিট করেছিল। আজও এফ এম রেডিও চ্যানেলে এই ছবির গানগুলো শ্রোতাদের কাছে খুব জনপ্রিয়।
তথ্যঋণ ঃ আজকাল শারদ সংখ্যা ও সা রে গা পত্রিকা
Probir Mitra
Monday, June 21, 2021
ও পাখী উড়ে আয়
যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া
1 টি মন্তব্য:
অসাধারণ লাগলো। সমৃদ্ধ হলাম প্রবীর.....
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন