­
Golden days, we left behind.....: আগস্ট 2021

Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০২১

চেনা গানের অজানা কথা ১০

 

চেনা গানের অজানা কথা ১০

চেনা গানের অজানা কথা-এর নবম এপিসোড-এ বলেছিলাম বাংলা আধুনিক থেকে ছায়াছবির গান, রম্যগীতি, কীর্তন আঙ্গিকের গান, নজরুলগীতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অবাধ বিচরণ, কারন গান ছিল তাঁর কাছে ঈশ্বরের মতো।  পাড়ায় তাঁর বাড়ীটিকে লোকজন গানের বাড়ী বলেই চিনতেন কারন বাড়ীর বাকী সদস্যদের নিরলস সঙ্গীত সাধনার কথা কারও অজানা ছিল না।  মানবেন্দ্র-এর কাকা রত্নেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, মনোজেশ্বর মুখোপাধ্যায় গানের জগতে ছিলেন এক একজন দিকপাল। বাবা নিজে গান না করলেও খুব ভালো এস্রাজ বাজাতে পারতেন। মুলত বাবার ইচ্ছেতেই মানবেন্দ্র গানের সাধনা চালু করেন। বাড়ীতে বড় বড় ওস্তাদেরা আসতেন এছাড়া প্রতি শনিবার নিয়ম করে বাড়ীতে বসত হরিনাম সংকীর্তনের আসর।  সে সব খুব ছোট থেকে শুনতে শুনতে গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসো নিজের অজান্তেই আরও তীব্র হয়ে গিয়েছিল ।  কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া থেকে তিনি শতহস্ত দূরে থাকতেন, আর সেই জন্যই মানবেন্দ্র কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত গান নি। আজ সেই  মজার গল্পটা বা ঘটনাটা আপনাদের শেয়ার করব যেটা থেকে উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর জন্য নয়।

কলেজ জীবনে মানবেন্দ্র ছিলেন খুব বেপরোয়া, নাছোড় আর আবেগী একজন মানুষ।   কলেজে গানের প্রতিযোগিতা হবে, যেখানে প্রতিযোগীকে গাইতে হবে কীর্তন, টপ্পা, ঠুংরি ও তার সাথে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।

তখন কলেজ পড়ুয়া যুবক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

অন্যান্যগুলো নিয়ে কোন সমস্যা নেই কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তো বাড়ীতে সেভাবে চর্চা হয় না। মাথায় হাত দিয়ে বসলেন কলেজ পড়ুয়া মানবেন্দ্র।   সমস্যার সমাধান নিয়ে এগিয়ে এলেন কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, বললেন, ‘তুই জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে যা, একমাত্র তিনিই তোকে এই যাত্রায় বাঁচাতে পারেন’।

 খুব ভোরে রবীন্দ্র সরোবর লেকে ব্যায়াম করার অভ্যাস ছিল মানবেন্দ্র-এর।  দেবব্রত বিশ্বাস তখন থাকতেন কাছেই সার্দান অ্যাভিনিউতে। সারাদিন তাঁর বাড়ীর দরজা ছিল অবারিত দ্বার, যে কেউ এসে তাঁর সাথে দেখা করতে পারত।   মানবেন্দ্র ভোরে ব্যায়াম সেরে তাঁর বাড়ীর দরজা ঠেলে ঢুকলেন।

জর্জ বিশ্বাস

 
এলোমেলো ঘর, ঘরের এককোণে মাশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়ে আছেন দেবব্রত বিশ্বাস। তখনও ঘুম ভাঙ্গে নি।  বেপরোয়া মানবেন্দ্র মশারি তুলে হাত দিয়ে ঠেলাঠেলি করে তাঁকে ডাকতে লাগলেন।   দেবব্রত বেশ বিরক্ত হয়ে ধড়মড় করে উঠে তিনি মানবেন্দ্রকে বলেই বসলেন, “আপনে তো মশাই খুব অসভ্য লোক, না বলে কয়ে আমার ঘরে ঢুকে একটা ঘুমন্ত লোককে তুলে দিলেন”।

ধমক খেয়ে বেশ ঘাবড়ে গেলেন মানবেন্দ্র, বুঝলেন একটা ভুল হয়ে গেছে।  ওদিকে দেবব্রত বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে যাঁতি দিয়ে সুপারি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলেন, “তা মশায়ের কি করা হয়?”

-     আজ্ঞে আমি ছাত্র, কলেজে পড়ি, জানালেন মানবেন্দ্র।

রাশভারী গলায় দেবব্রত বললেন, “দেখে তো মনে হয় না ভালো কিছু কাজ করা হয়। তা এইখানে আগমনের হেতু কি?”

-     ‘ইন্টারকলেজ কম্পিটিশনে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে, আমি আপনার কাছে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখব, আপনি যদি একটু সময় দেন তা হলে ভালো হয়’।

 

-     ‘তা প্রতিযোগিতাটা কবে হবে’ ?

 

-     ‘আজ্ঞে আজকে বিকেলে, আমাকে তার আগেই একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত রেডি করতে হবে’।

 

মানবেন্দ্র-এর কথা শুনে জর্জ বিশ্বাস তো অবাক, এই ছোকরা বলে কি!

 

এবার মানবেন্দ্র মরিয়া হয়ে বললেন, ‘আপনি আমার কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে খুব চেনেন, উনিই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন’।  

 

রত্নেশ্বরের নাম শুনে দেবব্রত একটু সদয় হলেন। তারপর হারমোনিয়ামটা কাছে টেনে নিয়ে মানবেন্দ্র-কে শেখাতে বসলেন ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশেরও পাখী’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি।   কিছুক্ষণবাদে দেবব্রত তাঁর বোন খুকীকে বললেন, ‘ওকে পেট ভরে খাইয়ে দিস আর যতক্ষণ না পর্যন্ত ওর গানটা ঠিক হচ্ছে ততক্ষন ওকে ছাড়বি না’।   এই বলে তিনি নিজের কর্মস্থল ‘ভারতীয়

বাড়ীতে গানের রেওয়াজে মানবেন্দ্র

জীবন বিমার’ অফিসে চলে গেলেন। ওদিকে বাধ্য ছাত্রের মতো মানবেন্দ্র, দেবব্রত বিশ্বাসের শেখানো রবীন্দ্রসঙ্গীতটি প্র্যাকটিস করেই চলেছেন।    কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল।  ‘দুত্তোর’ বলে উঠে পড়লেন আর বোন খুকীর বার বার নিষেধ সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে এলেন মানবেন্দ্র।


সন্ধ্যেবেলায় মানবেন্দ্র-এর জন্য আর এক চমক অপেক্ষা করছিল।   গানের কম্পিটিশনে গিয়ে দেখলেন বিচারকদের চেয়ারে শৈলজারঞ্জন মজুমদার, অনাদি দস্তিদারের পাশে বসে আছেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস। মানবেন্দ্রকে দেখে উনি সটান মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।  অবশেষে মানবেন্দ্র-এর ডাক যখন এল তখন তিনি অন্যান্য গানের পর গাইলেন সেইদিন সকালে শেখা সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি যেটি শিখিয়েছিলেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস।  অন্যান্য গানগুলি অসাধারন গাইলেন কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে জর্জ বিশ্বাস তাকে কোন নম্বরই দিলেন না।   সেদিন কিন্তু মানবেন্দ্র সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

বাংলা সঙ্গীতের চলন্ত বিশ্বকোষ বিমান মুখোপাধ্যায়

 

 এর কিছুদিন পর আবার সার্দান অ্যাভিনিউ-এর বাড়ীতে মানবেন্দ্র আসতেই জর্জ বিশ্বাস বলে বসলেন, ‘শুনুন ভাই, আপনাকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। এটাই আপনার প্রথম ও শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই লাইন আপনার জন্য নয়’।

 জর্জ বিশ্বাসের এই আদেশ পরবর্তী কালে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তিনি আর কোনদিন রবীন্দ্রসংগীত গান নি বা রেকর্ড করেন নি।           

তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত না গাইলেও বাঙ্গালীর কাছে কাজী নজরুল ইসলামের গানকে কিন্তু জনপ্রিয় করেন মানবেন্দ্র । বাঙ্গালী একসময় কাজী নজরুল ইসলামকে ভুলতে বসেছিল আর সেটা অনুভব করে মানবেন্দ্র যখন যেখানেই অনুষ্ঠানে যেতেন সেখানেই অন্য গানের সাথে গাইতেন নজরুলের গান।   এদিকে সবাই তখন ফিল্মি গান, আধুনিক গান শুনতে চান কিন্তু সবার আগে তিনি প্রাধান্য দিতেন তাঁর ছোটবেলার গান শেখার গুরু কাজী নজরুল ইসলামের গানকে।   অবশেষে হিন্দুস্থান রেকর্ডের কর্ণধার সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত এগিয়ে এলেন এবং ‘Best love songs of Kaji Nazrul Islam’ নামে একটি এল পি রেকর্ড প্রকাশিত হল।  সেখানে মানবেন্দ্র গাইলেন দুটি গান, ‘এত জল ও কাজল চোখে’ এবং ‘বউ কথা কও’।    রেকর্ড বাজারে রিলিজ হবার পর এতো বিক্রি হোল যে সেই রেকর্ড কোম্পানিকে একটা স্পেশাল ই.পি. রেকর্ড বের করতে হোল এবং রেকর্ড কভারে সেই প্রথমবার লেখা হোল ‘নজরুলগীতি’ শব্দটি,  এর আগে লেখা হত ‘Songs of Kazi Nazrul Islam’।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

এরপর বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি থেকে আসতে লাগলো নজরুলগীতি গাইবার ডাক,  কিন্তু অত গান কোথায়। প্রচুর গান লিখেছেন নজরুল কিন্তু তার কোন হদিশ নেই।  শেষ জীবনে নজরুল তখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।  সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে মানবেন্দ্র স্মৃতিচারনা করেছেন যে, ’৭১ সালে মুজিবর রহমন সাহেব যখন কলকাতায় এলেন তখন একদিন কবির জন্মদিনে ক্রিস্তোফার রোডের বাড়ীতে গেলাম গান গাইতে,  সঙ্গে রাধাকান্ত নন্দীকে নিয়ে।  সেজেগুজে বসে আছেন কবি নজরুল। কি ট্র্যাজিক সেই নীরবতা।  কবির লেখা ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ দিয়ে গান শুরু করে যে কত গান গেয়েছিলাম সেদিন। এক সময়ের বিদ্রোহী কবি সেদিন নীরব হয়ে আমার গান শুনেছিলেন আর চোখ দিয়ে নেমে এসেছিল জলের ধারা’। 

অবশেষে মানবেন্দ্র-এর সঙ্গীতজীবনে ভগবানের মতো এলেন বাংলা সঙ্গীতের চলন্ত বিশ্বকোষ বিমান মুখোপাধ্যায় অসংখ্য নজরুলের গানের ভাণ্ডার নিয়ে। যে আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী একদিন নজরুলকে ভুলতে বসেছিল, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় একের পর এক নজরুলের গান গেয়ে যেন ধাক্কা দিয়ে হুঁশ ফেরালেন বাঙ্গালীর।     

তথ্যঋণ ঃ আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি – দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় (আনন্দবাজার আর্কাইভ) ।

দূরদর্শনে দেওয়া মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার । 

 জর্জ বিশ্বাসের গাওয়া সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত যেটি মানবেন্দ্র শিখেছিলেন তাঁর কাছে

 মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড করা প্রথম নজরুল গীতি

 মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড করা প্রথম নজরুল গীতি

প্রবীর মিত্র 

২২/০৮/২০২১

বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

চেনা গানের অজানা কথা - ৯

 

চেনা গানের অজানা কথা - ৯ 

প্রবীর মিত্র  

 

চেনা গানের অজানা কথা-এর দ্বিতীয় এপিসোড যারা পড়েছেন তাঁরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন ‘আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানটি ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূতে পাওয়া গান, অর্থাৎ একটা অলৌকিক সূত্রে তিনি এই গানের সুর রচনা করেন। যারা এই এপিসোডটি এখনো পড়ে উঠতে পারেন নি তাঁদের জন্য লিংক দিয়ে দিলাম (চেনা গানের অজানা কথা – ২)।  বাংলায় মানবেন্দ্র-এর গাওয়া দুটি গান ‘যদি জানতে গো’ এবং ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’ –এর হিন্দি ভার্সন যখন করার কথা মনস্থির করছেন সুরকার সলিল চৌধুরী, তখন গায়িকা লতা মঙ্গেশকর সলিলবাবুকে বলেছিলেন, “খুব কঠিন সুর, এই গান গাওয়া আমার পক্ষে খুব সোজা হবে না”।  উত্তরে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, “লতাজি এই গান বাংলায় ইতিমধ্যে গেয়ে রেকর্ড করে ফেলেছেন আমাদের বাংলারই এক শিল্পী”।  গানটি যখন লতাজি শুনলেন এবং জানলেন বাংলার সেই শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তখন তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর সাথে আলাপ করার এবং সেই সুযোগ মিলেছিল কোলকাতার হোপ এইট্টীসিক্স-এর অনুষ্ঠানে।    বাংলা আধুনিক থেকে ছায়াছবির গান, রম্যগীতি, নজরুল গীতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ছিল মানবেন্দ্র-এর অবাধ বিচরণ। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া থেকে তিনি শতহস্ত দূরে থাকতেন, আর সেই জন্যই মানবেন্দ্র কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত গান নি, সেটারও একটা মজার গল্প আছে, তবে সেটা আজ নয় অন্যদিন জানাব।   আজ এই শিল্পী ৯২-তে পদার্পণ করলেন (১১ই আগস্ট, ১৯২৯)। উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ ও সন্ধ্যা রায় অভিনীত ‘মায়ামৃগ’ (১৯৬০) ছবির একটি গানের নেপথ্যকাহিনী আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব। 

‘মায়ামৃগ’ (১৯৬০) ছবির গীতিকার ছিলেন মানবেন্দ্র-এর অভিন্নহৃদয় বন্ধু শ্যমল গুপ্ত। তাঁদের বন্ধুত্বের বয়েস

মায়ামৃগ ছবির পোস্টার

অনেকদিনের যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাথে শ্যামলবাবুর বিয়ে হয় নি।   ‘মায়ামৃগ’-এর গান যখন বাধাঁ হচ্ছে তখন গীতিকার শ্যামল গুপ্তকে ওই ছবির সুরকার মানবেন্দ্র বললেন, “নায়ক বিশ্বজিৎ নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু নায়কের সব কথাতেই ডাক্তারীর নানারকম প্রতিশব্দ এসে পড়ে, কারণ নায়ক ডাক্তারি পড়ছে ছবিতে। এমনকি প্রেম নিবেদনের সময়তেই রক্ষা নেই, সেখানেও বেরিয়ে পড়ে ডাক্তারি শাস্ত্রের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।  এটাকে মাথায় রেখে একটা গান লিখে ফেল চটপট”।

গীতিকার শ্যামল গুপ্ত

মানবেন্দ্র তখন ফার্ন রোডে “গীতিবীথিকা” নামে একটি স্কুলে গান শেখান। ক্লাসের পর সেখানে বন্ধু শ্যামলের সাথে গানের মজলিসি আড্ডাও হয়।  সেইরকমই এক রবিবারের বিকেলে মজলিসি গানের আড্ডা চলছে।  কিছুক্ষন কথাবার্তা চলার পর শ্যামল পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বার করলেন মানবেন্দ্র-এর ফরমাশ করা তাঁর ‘মায়ামৃগ’ ছবির জন্য লেখা একটি গান।  গানের কথা পড়ে মানবেন্দ্র ধমকে উঠলেন, “ছ্যা ছ্যা এটা কি করেছিস শ্যামল, এটা একটা গান হয়েছে ? একেবারে যাতা”,
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

বলে কাগজের টুকরোটা দলামচা করে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মানবেন্দ্র। বন্ধুর এই আকস্মিক ব্যবহারে একেবারে চুপসে গেলেন মৃদুভাষী শ্যামল।     

এরপর মানবেন্দ্র তাঁর ছাত্রছাত্রীদের দিকে মননিবেশ করলেন গান শেখানোর মধ্যে দিয়ে।  ঘণ্টা দুই পরে ক্লাশ শেষে মানবেন্দ্র লক্ষ্য করলেন ঘরের এককোনে তাঁর বন্ধু মুখ কাঁচুমাচু করে সিগারেট খাচ্ছেন।  হয়ত এবার একটু মায়া হল মানবেন্দ্র-এর।  বললেন, “ওরে আর মন খারাপ করিস নি, দেখি গানের কাগজটা একবার, আর একটু ভালো করে পড়ে দেখি”।   এবার বন্ধুর উপর রাগে ফেটে পড়লেন শ্যামল, “গানের কাগজটা কি তুই আস্ত রেখেছিস, তুই তো জানলা দিয়ে ফেলে দিলি, আমার কাছে আর কোন কপি নেই, বাসে ট্রামে আসতে আসতে মাথায় যা এসেছিল তখন তাই লিখে ফেলেছিলাম”।

মানবেন্দ্র বুঝলেন, ঝোঁকের মাথায় একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন। এদিকে তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। লোডশেডিং –এর জন্য রাস্তায় আলো প্রায় নেই বললেই চলে।  টর্চ হাতে নেমে পড়লেন মানবেন্দ্র দলামচা করে ফেলে দেওয়া গানের কাগজটি খুঁজে পাবার জন্য।  শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজার পর দলা পাকানো কাগজটার খোঁজ মিলল নর্দমার পাশে।   অবশেষে সেই দলা পাকানো কাগজ নিয়েই বসলেন মানবেন্দ্র সুর করতে। সৃষ্টি হোল ‘মায়ামৃগ’ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’।  ছবিতে নায়ক বিশ্বজিতের লিপে গাইলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজে।  ছবির গান একেবারে সুপার হিট এবং পরবর্তীকালে মানবেন্দ্র যেখানেই লাইভ ফাংশান করতে যেতেন সেখানেই শ্রোতাদের ফরমাশ থাকত এই গানটি শোনানোর জন্য।   আজও ৬০ বছর পর বিশেষ কিছু এফ এম রেডিও স্টেশন-এ সম্প্রচারিত হওয়া এই গান শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়।  

তথ্যঋণ ঃ আনন্দবাজার আর্কাইভ  

 
মায়ামৃগ ছবির সেই বিখ্যাত গান 

বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১

হিন্দি বলয়ের উপেক্ষিত এক উত্তমপুরুষ

 হিন্দি বলয়ের উপেক্ষিত এক উত্তমপুরুষ

প্রবীর মিত্র

(কিছুদিন আগে আমরা পেরিয়ে এলাম উত্তমকুমারের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী (২৪শে জুলাই ১৯৮০)।  আজ এতো বছর পরেও আপামর বাঙ্গালীর হৃদয়ে উত্তমকুমার এক ম্যাটিনি আইডল।   আজ এই লেখার মাধ্যমে বাঙ্গালীর এই উত্তম আবেগকে একটু অন্যভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় রইলাম।)

ছোট থেকেই অরুনের মাথায় ছিল থিয়েটার-এর পোকা, স্বপ্ন দেখতেন বাংলা ছবির নায়ক হবার, সিনেমার প্রমথেশ বড়ুয়া, কে.এল.সাইগল ও থিয়েটারের শিশির ভাদুড়ী ছিলেন তাঁর স্বপ্নের হিরো, কিন্তু বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সামান্য মাইনের মেট্রো সিনেমা হলের প্রোজেক্টর অপারেটর, সংসারের চাপ তিনি আর নিতে পারছিলেন না।  সেটা উপলব্ধি করেই  ১৯৪৫ সালে বি.কম. পাশ করেই বাড়ীর বড় ছেলে হিসাবে অরুন আঁতিপাঁতি করে একটা চাকরী খুঁজছিলেন।  অবশেষে মেজমামার সুপারিশে মাসিক দুশো পঁচাত্তর টাকায় পোর্ট ট্রাস্টের একটা সাধারন কেরানীর চাকরী জুটল।  কিন্তু মনটা যে পড়ে রয়েছে রূপোলী পর্দায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। সারাদিন অফিসের পর সন্ধ্যেবেলায় এসে জুটতেন পাড়ার ক্লাবে শখের থিয়েটারের রিহার্সালে অথবা

বাঙ্গালীর ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমার

বাড়ীতে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গাইতেন সাইগল সাহেবের সিনেমার গান।  পাড়ার দুর্গা পুজো থেকে স্বরসতী পুজোর জলসায় গানে ও নাটকে অরুন ছিল নিয়মিত অংশগ্রহণকারী।  একদিন ক্লাবে একটি নাটকের রিহার্সাল চলাকালীন ঘটনাচক্রে আলাপ হয় গনেশদা নামে এক সখের অভিনেতার সাথে আর তার হাত ধরেই অরুন প্রথম পা রাখলেন ভারতলক্ষী স্টুডিয়োর অন্দরে অফিস কামাই করে।  ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি ছবির শ্যুটিং চলছিল তখন, খুব ছোট্ট একটা রোল, প্রবল উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে শট দিলেন অরুন।  তারপর চাতক পাখীর মতো অপেক্ষা করতে লাগলেন ছবি রিলিজের জন্য, ছোট্ট একটা রোল, তাতে কি, তাঁর জীবনের প্রথম রূপোলী পর্দায় মুখ দেখানো বলে কথা।   কিন্তু বিধি বাম, কয়েকদিন পর জানতে পারলেন ছবির কাজ আটকে গেছে, প্রযোজক হাত গুটিয়ে নিয়েছেন ছবি থেকে, কারণ তখন ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি, ভারত তখন স্বাধীন হবার পথে, উত্তল সময়, তাই পোর্ট ট্রাস্টের একটা সাধারন কেরানীর স্বপ্ন অধুরাই থেকে গেল।  অরুনের জীবনের প্রথম ছবি (হিন্দি) ‘মায়াডোর’ কালের গর্ভে চলে গেল।   বাকী টুকু পড়ার জন্য ক্লিক করুন...।।