চেনা গানের অজানা কথা - ৯
প্রবীর মিত্র
চেনা গানের অজানা কথা-এর দ্বিতীয় এপিসোড যারা পড়েছেন তাঁরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন ‘আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানটি ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূতে পাওয়া গান, অর্থাৎ একটা অলৌকিক সূত্রে তিনি এই গানের সুর রচনা করেন। যারা এই এপিসোডটি এখনো পড়ে উঠতে পারেন নি তাঁদের জন্য লিংক দিয়ে দিলাম (চেনা গানের অজানা কথা – ২)। বাংলায় মানবেন্দ্র-এর গাওয়া দুটি গান ‘যদি জানতে গো’ এবং ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’ –এর হিন্দি ভার্সন যখন করার কথা মনস্থির করছেন সুরকার সলিল চৌধুরী, তখন গায়িকা লতা মঙ্গেশকর সলিলবাবুকে বলেছিলেন, “খুব কঠিন সুর, এই গান গাওয়া আমার পক্ষে খুব সোজা হবে না”। উত্তরে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, “লতাজি এই গান বাংলায় ইতিমধ্যে গেয়ে রেকর্ড করে ফেলেছেন আমাদের বাংলারই এক শিল্পী”। গানটি যখন লতাজি শুনলেন এবং জানলেন বাংলার সেই শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তখন তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর সাথে আলাপ করার এবং সেই সুযোগ মিলেছিল কোলকাতার হোপ এইট্টীসিক্স-এর অনুষ্ঠানে। বাংলা আধুনিক থেকে ছায়াছবির গান, রম্যগীতি, নজরুল গীতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ছিল মানবেন্দ্র-এর অবাধ বিচরণ। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া থেকে তিনি শতহস্ত দূরে থাকতেন, আর সেই জন্যই মানবেন্দ্র কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত গান নি, সেটারও একটা মজার গল্প আছে, তবে সেটা আজ নয় অন্যদিন জানাব। আজ এই শিল্পী ৯২-তে পদার্পণ করলেন (১১ই আগস্ট, ১৯২৯)। উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ ও সন্ধ্যা রায় অভিনীত ‘মায়ামৃগ’ (১৯৬০) ছবির একটি গানের নেপথ্যকাহিনী আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব।
‘মায়ামৃগ’ (১৯৬০) ছবির গীতিকার ছিলেন মানবেন্দ্র-এর অভিন্নহৃদয় বন্ধু শ্যমল গুপ্ত। তাঁদের বন্ধুত্বের বয়েস
মায়ামৃগ ছবির পোস্টার |
অনেকদিনের যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাথে শ্যামলবাবুর বিয়ে হয় নি। ‘মায়ামৃগ’-এর গান যখন বাধাঁ হচ্ছে তখন গীতিকার শ্যামল গুপ্তকে ওই ছবির সুরকার মানবেন্দ্র বললেন, “নায়ক বিশ্বজিৎ নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু নায়কের সব কথাতেই ডাক্তারীর নানারকম প্রতিশব্দ এসে পড়ে, কারণ নায়ক ডাক্তারি পড়ছে ছবিতে। এমনকি প্রেম নিবেদনের সময়তেই রক্ষা নেই, সেখানেও বেরিয়ে পড়ে ডাক্তারি শাস্ত্রের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। এটাকে মাথায় রেখে একটা গান লিখে ফেল চটপট”।
![]() |
গীতিকার শ্যামল গুপ্ত |
মানবেন্দ্র তখন ফার্ন রোডে “গীতিবীথিকা” নামে একটি স্কুলে গান শেখান। ক্লাসের পর সেখানে বন্ধু শ্যামলের সাথে গানের মজলিসি আড্ডাও হয়। সেইরকমই এক রবিবারের বিকেলে মজলিসি গানের আড্ডা চলছে। কিছুক্ষন কথাবার্তা চলার পর শ্যামল পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বার করলেন মানবেন্দ্র-এর ফরমাশ করা তাঁর ‘মায়ামৃগ’ ছবির জন্য লেখা একটি গান। গানের কথা পড়ে মানবেন্দ্র ধমকে উঠলেন, “ছ্যা ছ্যা এটা কি করেছিস শ্যামল, এটা একটা গান হয়েছে ? একেবারে যাতা”,
![]() |
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় |
বলে কাগজের টুকরোটা দলামচা করে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মানবেন্দ্র। বন্ধুর এই আকস্মিক ব্যবহারে একেবারে চুপসে গেলেন মৃদুভাষী শ্যামল।
এরপর মানবেন্দ্র তাঁর ছাত্রছাত্রীদের দিকে মননিবেশ করলেন গান শেখানোর মধ্যে দিয়ে। ঘণ্টা দুই পরে ক্লাশ শেষে মানবেন্দ্র লক্ষ্য করলেন ঘরের এককোনে তাঁর বন্ধু মুখ কাঁচুমাচু করে সিগারেট খাচ্ছেন। হয়ত এবার একটু মায়া হল মানবেন্দ্র-এর। বললেন, “ওরে আর মন খারাপ করিস নি, দেখি গানের কাগজটা একবার, আর একটু ভালো করে পড়ে দেখি”। এবার বন্ধুর উপর রাগে ফেটে পড়লেন শ্যামল, “গানের কাগজটা কি তুই আস্ত রেখেছিস, তুই তো জানলা দিয়ে ফেলে দিলি, আমার কাছে আর কোন কপি নেই, বাসে ট্রামে আসতে আসতে মাথায় যা এসেছিল তখন তাই লিখে ফেলেছিলাম”।
মানবেন্দ্র বুঝলেন, ঝোঁকের মাথায় একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন। এদিকে তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। লোডশেডিং –এর জন্য রাস্তায় আলো প্রায় নেই বললেই চলে। টর্চ হাতে নেমে পড়লেন মানবেন্দ্র দলামচা করে ফেলে দেওয়া গানের কাগজটি খুঁজে পাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজার পর দলা পাকানো কাগজটার খোঁজ মিলল নর্দমার পাশে। অবশেষে সেই দলা পাকানো কাগজ নিয়েই বসলেন মানবেন্দ্র সুর করতে। সৃষ্টি হোল ‘মায়ামৃগ’ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’। ছবিতে নায়ক বিশ্বজিতের লিপে গাইলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজে। ছবির গান একেবারে সুপার হিট এবং পরবর্তীকালে মানবেন্দ্র যেখানেই লাইভ ফাংশান করতে যেতেন সেখানেই শ্রোতাদের ফরমাশ থাকত এই গানটি শোনানোর জন্য। আজও ৬০ বছর পর বিশেষ কিছু এফ এম রেডিও স্টেশন-এ সম্প্রচারিত হওয়া এই গান শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়।
তথ্যঋণ ঃ আনন্দবাজার আর্কাইভ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন