Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

কেরানী থেকে অভিনেতা – গল্প হলেও সত্যি


কেরানী থেকে অভিনেতা – গল্প হলেও সত্যি
প্রবীর মিত্র

আসল নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ । বাচ্ছা থেকে বুড়ো সকলের কাছে এই নাম অপরিচিত হলেও সংক্ষিপ্ত নাম ‘রবি ঘোষ’ নামেই তিনি নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় তাঁর সিরিয়াস ও কমেডি অভিনয়ের জন্য ।   গত ২৪শে নভেম্বর, অভিনেতা রবি ঘোষ-র ৮৮ তম জন্মদিন পালন করল কোলকাতার চিত্রজগত । 

তপন সিনহা পরিচালিত ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে ধনঞ্জয় রূপি রবি ঘোষ
চেহারায় ছোট্টখাট্ট রবি ঘোষ, ৫০-র দশকের প্রথমদিকে যখন পাড়ার স্টেজে শখের থিয়েটার ছোটখাট রোল এ অভিনয় করতে শুরু করলেন, তখন তাঁর পিতৃদেব জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ তাঁকে এসব ছেড়ে একটা চাকরি বাকরির চেষ্টা করতে বললেন যেটা স্বাভাবিক একটা সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে । আসলে তিনি ভেবেছিলেন অতি সাধারন একটা বেঁটেখাট চেহারার ছেলের অভিনয় লাইনে কিছু হবে না । এমনকি জিতেন্দ্রনাথবাবু তাঁর সহধর্মিণীকে বলেছিলেন, “বুজলে গিন্নী, রবু-র নাকি অভিনয়ে শখ হইছে । ওর তো চাকর বাকর ছাড়া কোনও পার্ট জুটবো না” ।  হয়ত এই কথাটাই  রবি ঘোষ-র মধ্যে একটা জেদের সৃষ্টি করেছিল সেই সময়এর কিছুদিন পর কলকাতা পুলিশ কোর্টে একটা কেরানীর চাকরি জুটল অর্থাৎ বেকার রবি এবার সকার হোল । কিন্তু বিধিবাম, কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারলেন না রবি ।  সুযোগ এল ১৯৫৯-এ । পরিচালক অরবিন্দ মুখারজি তাঁর কিছুক্ষনছবিতে একটা ছোট রোল এ সুযোগ দিলেন রবিকে    শুটিং চলাকালীন আলাপ হোল প্রবাদপ্রতিম নাট্য ব্যাক্তিত্ব উৎপল দত্তের সঙ্গে ।  ১৯৬১ সালে উৎপল রবিকে ডেকে নিলেন তাঁর পরিচালিত ছবি ‘মেঘ’ এ অভিনয়ের জন্য ।  সেটিও খুব বড় রোল না হলেও উৎপল দত্ত বুজলেন রবির নাট্য প্রতিভার কথা । ডাক দিলেন পি.এল.টি. তে যোগদানের জন্য । ব্যস রবি ঘোষের চাকরি জীবনের ইতি । উৎপল দত্ত, শোভা সেন, সত্য ব্যানারজি প্রমুখ নাট্য ব্যাক্তিত্বদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুরু করলেন থিয়েটার জীবন ।   পরে রবি ঘোষ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন থিয়েটার অভিনয়ে উৎপল দত্ত তাঁর গুরু । কারণ থিয়েটারের  ‘অ আ ক খ’ তিনি উৎপল দত্তের কাছ থেকে একেবারে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছেন ।   এর পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের আরও কিছু নমস্য ব্যাক্তি তপন সিনহা, সত্যজিৎ  রায়, তরুন মজুমদার প্রমুখর কথা উল্লেখ করতে তিনি ভোলেন নি । ১৯৬০ সালে পি.এল.টি.-এর বিখ্যাত নাটক ‘অঙ্গার’ এর জন্য উল্টোরথ পত্রিকা থেকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হন ।    ১৯৬২ সালে পরিচালক তপন সিনহা তাঁকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প হাসুলি বাঁকের উপকথাছবিতে একটা বড় ব্রেক দেন    
  
প্রথম জীবনে রবি শরীর চর্চার দিকে মন দিয়েছিলেন  (বামদিকের ছবি) , সত্যজিৎ রায়ের জন অরন্য ছবিতে রবি ঘোষ  (ডানদিকের ছবি)
এরপর সত্যজিৎ রায়ের সাথে আলাপ হয় রবি ঘোষের ।  সেটাও একটা মজার ঘটনা । উৎপল দত্তের সঙ্গে মানিকবাবুর পরিচয় ছিল আগেই ।  একদিন উৎপল দত্তের থিয়েটার চলাকালীন একটি দৃশ্যে মানিকবাবুর চোখে পড়ে যান রবি । মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তাঁর আগামী ছবি ‘অভিযান’ এর জন্য একটি চরিত্রে তিনি রবিকে দিয়ে অভিনয় করাবেন ।  রবি তো এক কথায় রাজী । তারপর ইতিহাস ।   ইতিমধ্যে রবি, তপন সিনহা থেকে শুরু করে তরুন মজুমদার প্রমুখ বিভিন্ন চিত্রপরিচালকদের সাথে চুটিয়ে কাজ করছেন এবং প্রাণপণে প্রমান করার চেষ্টা করছেন তিনি শুধুমাত্র একজন ছোট্টখাট্ট চেহারার কমিক অভিনেতাই নন একজন সিরিয়াস অভিনেতাও বটে যার অভিনয়ের মধ্যে কিছুটা কমেডি মেশানো সিরিয়াস শেড থাকে । এর জন্য তিনি পরিচালকদের ধন্যবাদও জানিয়েছেন তাঁর ভিতর অভিনয় সত্ত্বাটাকে লোকের সামনে তুলে ধরার জন্য ।   ১৯৬৬ সালে রিলিজ হওয়া তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিটার কথা মনে করার চেষ্টা করুন ।  লুজ কমেডি ও সিরিয়াস কমেডি এই দুটো ব্যাপারে হয়তো অনেকের সঠিক ধারনা নেই   কমেডি অভিনয় যে একটা ফরম হতে পারে সেটা তপন সিনহা করে দেখালেন তাঁর গল্প হলেও সত্যিছবির মাধ্যমে ছবির প্রধান চরিত্র একজন কমেডি অভিনেতা চাকর ধনঞ্জয়রুপী রবি ঘোষের অসাধারন সিরিয়াস কমেডি অভিনয় যার মাধ্যমে একটা ভাঙ্গা সংসার জুড়ে যাবার বার্তা থাকে   প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ওই ছবিতে পরিচালক তপন সিনহা রবি ঘোষ কে দিয়ে একটা গানও গাইয়ে ছেড়েছেন (https://www.youtube.com/watch?v=O5kx1SDGePI) পরে এই ছবিটা পরিচালক হৃষীকেশ মুখারজি বাবুর্চিনামে হিন্দি ভারশনেও করেন যেখানে রবি ঘোষের ভূমিকায় ছিলেন সুপারস্টার রাজেশ খান্না কিন্তু বোম্বের সুপারস্টারের অভিনয় বাংলার রবি ঘোষের অভিনয়ের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল   
সত্যজিৎ রায়ের কাপুরুষ ও মহাপুরুষ ছবির একটি দৃশ্যতে রবি ঘোষ 
            
১৯৬৮ সালে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে দ্বিতীয়বার ডাক এল তাঁর মিউজিক্যাল কমেডিগুপী গাইন বাঘা বাইনএর জন্য   গুপীর চরিত্রে তপেন চট্টোপাধ্যায় ও বাঘার চরিত্রে রবি ঘোষ এর অভিনয় বাংলা ছবির জগতে একটা মাইলস্টোন ।  ১৯৭০ সালে এই ছবিটি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এ বিশেষ সন্মানে ভূষিত হয় এবং সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখেন রবি । এই সিরিজের পরবর্তী দুটি ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’ ও ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ এই জুটির সফল কাজ বাচ্চা বুড়ো সবাইকে আজও চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে ।     

আসলে রবি ঘোষ বিশ্বাস করতেন একটু বড় মাপের শিক্ষিত পরিচালক না হলে কমেডি অভিনয় এর বিভিন্ন ফরমগুলো ঠিক মত মেলে ধরতে পারেন না অভিনেতারা  একটা উদাহরন দেওয়া যায়, অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী পরশপাথরছবিতে অভিনয়ের আগে উনি একজন শুধু কমিক অভিনেতা ছিলেন একমাত্র সাড়ে চুয়াত্তর বাদে অন্যান্য সব ছবিতেই তাঁর ভুমিকা ছিল কমিক রিলিফের মাধ্যমে ছবিতে হাস্যরস সৃষ্টি করা  তাও কিছু সময়ের জন্য কিন্তু সত্যজিৎ রায় তাঁরপরশপাথরছবির মাধ্যমে তুলসী চক্রবর্তীকে চেনালেন একজন জাত অভিনেতা হিসাবে সে প্রসঙ্গ আর একদিন করা যাবে     
গুপী গাইন ও বাঘা বাইন ছবির একটি দৃশ্য ডানদিকে রবি ঘোষের সঙ্গে গুপী তপেন চট্টোপাধ্যায়

রবি ঘোষ তাঁর থিয়েটার অভিনয়ের পাশাপাশি প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ টি বাংলা ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে তাঁর সুক্ষ অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন । পরিচালক হৃষীকেশ মুখারজি রবিকে তাঁর পরিচালিত দুটি হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন । ‘সত্যকাম’ (১৯৬৯) এবং ‘সব সে বড়া সুখ’ (১৯৭২) ছবি দুটি খুব একটা হিট না করলেও হিন্দিতে রবির অভিনয় লা জাবাব ছিল । ইতিমধ্যে রবি দুটি ছবির পরিচালনার ভারও নিয়েছিলেন একটা সেলফ এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য । চিন্ময় রায় ও জয়া ভাদুড়ীকে নিয়ে করলেন ‘সাধু জুধিস্টিরের কড়চা’ (১৯৭৪) নিজেও একটা চরিত্রে থাকলেন কিন্তু দর্শক নিল না ছবিটাকে । এরপর মহানায়ক উত্তমকুমারকে নিয়ে করলেন ‘নিধিরাম সর্দার’ (১৯৭৬) কিন্তু সেটাও ফ্লপ করল উত্তমকুমার থাকা সত্বেও রবি বুজলেন সিনেমার পরিচালক হওয়া তাঁর কম্ম নয় ।  আবার মন দিলেন এক্স পেরিমেন্টাল অভিনয়ের দিকে ।    

৯০ এর দশকের প্রথম দিকে সত্যজিৎ রায়ের শেষ ছবি ‘আগুন্তুক’ অভিনয়ের পর তিনি এবার মন দিলেন  দূরদর্শনের টেলিছবির দিকে । বেশ কিছু ভালো টেলি ছবি আমরা পেয়েছি সেই সময় ।  সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ দুরদর্শনের জন্য বানালেন দুটি ফেলুদা ছবি যাতে  জটায়ুর ভূমিকায় নামলেন রবি ঘোষ ।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সন্তোষ দত্তের পর তিনিই দ্বিতীয় জটায়ু । 

দিনটা ছিল ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ । দূরদর্শনের শুটিং চলছিল ‘হুতোমের নকশা’র ‘সিধেল চোর’ পর্বের ।  পরিচালক তপন সিনহা ।  লাঞ্চ ব্রেক চলছে । কেউ খাবার নিয়ে ব্যস্ত । কেউ মেক-আপ তুলতে । রবি ঘোষ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন । অন্তত সবাই সেটাই জানত । কিন্তু সেটাই ছিল রবি ঘোষের শেষ বিশ্রাম ।  একেবারে নিঃশব্দে কাউকে জানান না দিয়েই তিনি চলে গেলেন । সাজঘরেই মৃত্যু এসে নিয়ে গেল অভিনেতা রবিকে ।   আজও ইউটিউব বা টিভি-তে যখন রবি ঘোষের সিনেমা দেখি তখন মনটা একটা দারুন প্রশান্তিতে ভরে যায় ।   এই ভাবেই হয়তো তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন ।    
         

তথ্যঋণ ঃ- আনন্দলোক, উল্টোরথ ও বিভিন্ন টেলি মাধ্যমে প্রচার হওয়া রবি ঘোষের সাক্ষাৎকার  

শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৯

ছবি রায় হলেন রুবি রায়




ছবি রায় হলেন রুবি রায়

প্রবীর মিত্র


 
১৯৬৯ এ প্রথম নিজের সুরে নিজেই গান রেকর্ড করলেন রাহুল দেব বর্মণ । পুজোর গানের জন্য সুর তৈরি করলেন রাহুল । গানটি কিশোরকুমার গাইবেন ঠিক হল  । কিশোর মন দিয়ে শুনলেন কিন্তু খুব একটা পছন্দ হোল না । তখন রাহুল ঠিক করলেন গানটি তিনি নিজেই গাইবেন । সুর তো তৈরি কিন্তু গানের কথা কে যোগাবেন ? রাহুল ধরে বসলেন তাঁর বন্ধু শ্রী শচিন গুপ্তকে । সেই সময় শচিনবাবু বোম্বাই এর বেশ কয়েকটি ছবিতে চিত্রনাট্য লেখার কাজে ব্যস্ত ।  শচিন গুপ্ত তো কোনদিন গান লেখেননি ।  এদিকে রাহুল নাছোড়বান্দা, যেমন করেই হোক পুজোর জন্য একটা গান তার চাই চাই । তখন  শচিনবাবু তাঁর স্কুলজীবনের বান্ধবী ছবি রায়  (হয়তো শচিন গুপ্ত-এর প্রথম প্রেমিকা যার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ছিলেন তিনি)   এর কথা স্মরণ করে লিখে ফেললেন সেই বিখ্যাত গান “মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি” । শচিন গুপ্ত এর কলমের আঁচড়ে ছবি রায় হয়ে গেলেন রুবি রায় ।  কিরওয়ানি রাগের আধারে সুর করা সেই ট্র্যাজিক প্রেমের গান আধুনিক বাংলা গানের জগতে শুধু এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল তাই নয় সেই গান বাংলার সব কলেজ পড়ুয়াদের বুকে ঝড় তুলে দিয়েছিল একেবারে । এর বহু বছর পর গায়ক রূপঙ্কর রুবি রায়কে নতুন ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন ।  আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই একজন করে রুবি রায় হয়তো আছেন  যিনি পুরুষ ও হতে পারেন আবার মহিলাও যাকে নীরবে ভালোবাসা যায়, শ্রদ্ধা  করা যায় ।   এর ঠিক চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালেরুবি রায়”-গানের সুর বসিয়ে  রাহুল দেব বর্মণ অনামিকাছবির জন্য তৈরি করলেন  একটি হিন্দি গান যেটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার মেরি ভিগি ভিগি সি প্যাল কো রহে গ্যায় গানটি সিনেমায় সঞ্জীবকুমারের লিপে বেশ হিট হয়েছিল সেই সময় বলা বাহুল্য  রাহুল দেব বর্মনের গাওয়া সেই প্রথম পুজোর গান “রুবি রায়” এই বছর সুবর্ণজয়ন্তীতে পা দিল   
 
রাহুল দেব বর্মণ

                         গীতিকার শচীন গুপ্ত ...
এবার মন দিয়ে শুনুন আর অনুভব করুন   রুবি রায়



তথ্যসূত্র  আনন্দলোক, আজকাল পত্রিকা এবং অন্তরজাল