Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০

বেতার নাটকে ফেলুদা ...

                     বেতার নাটকে ফেলুদা 

প্রত্যেক রবিবার দুপুরে ৯৮.৩ রেডিও মির্চি মানেই সানডে সাসপেন্স । আমার মতো অনেক রেডিও পাগল এটি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে । কিন্তু এখন কোন এপিসোড মিস হলে youtube  থেকেই সেটি online stream করেই শুনে নেওয়া যায় । যদি আমি খুব ভুল না করি তাহলে বিগত দশ বছর বা তার কিছু অধিক সময় ধরে চলে আসা এই জনপ্রিয় নাটকের অনুষ্ঠানটি তার যাত্রা শুরু করেছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘সেপ্টোপাশের খিদে’ গল্পের পাঠ অভিনয়ের মাধ্যমে ।   মির্চির জনপ্রিয় প্রেসেন্টার দীপনারায়ণ ঘোষ অথবা সংক্ষেপে ‘দীপ’ অসাধারন পাঠ করেছিলেন এই জনপ্রিয় গল্পটির, যদিও আগে পড়া ছিল গল্পটা । কিন্তু সেই প্রথম রেডিও র মাধ্যমে বই পড়ার একটা দারুন আনন্দ অনুভব করেছিলাম ।  আর এই রেডিও স্টেশন থেকেই প্রথম শুনি “ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি” গল্পের নাট্যপাঠ যেটি সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রথম ফেলুদা গল্পও বটে ।   
     খুব ছোট থেকেই রেডিও আমাকে খুবই টানে ।   বেশী টিভি দেখলে পড়াশুনার প্রবল ক্ষতি তাই আমার মাধ্যমিক পর্যন্ত টিভি দেখাটা বাড়ীর অনুমতিসাপেক্ষ ছিল ।  কিন্তু রেডিও এর ক্ষেত্রে সে সব বাধা নিষেধ ছিল না ।  ৮০ এর দশকের রেডিও অনুষ্ঠানগুলি আমার শোনার কানকে তৈরি করে দিয়েছিল ।  অসাধারন কিছু গান, বিভিন্ন সেলিব্রিটির সাক্ষাৎকার, তৎকালীন রেডিও সঞ্চালকদের দুর্দান্ত সঞ্চালনা কান ভরে শুষে নিতাম ।  আর সেই সঙ্গে অবশ্যই কলকাতা ‘ক’ ও বিবিধ ভারতীর বিজ্ঞাপনদাতাদ্বারা আয়োজিত নাটক ।  না, এর জন্য আমার পড়াশুনার কোনদিন কোন ক্ষতি হয় নি । কি ভাগ্যিস সেই সময় ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ বা নিত্যনুতন স্যাটেলাইট চ্যানেলের হাতছানি ছিল না ।    
একটু ভূমিকা সেরে নিলাম, এবার আসি মূল প্রসঙ্গে ।  ১৯৬৮ সালের ১৫ই অক্টোবর কোলকাতায় বিবিধ ভারতী সম্প্রচার শুরু হবার সারাটা সময় রেডিও জুড়ে থাকত হিন্দি গান ও বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন ।  তারপর আস্তে আস্তে চালু হয় বিজ্ঞাপনের সাথে ছোট ছোট অল্প সময়ের নাটক । কিন্তু সেই অ্যানালগযুগের সেই সমস্ত অনুষ্ঠান প্রচারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল যেটা আমরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনাও করতে পারি না ।  যাদের কৈশোরকাল ৮০ এর দশকে কেটেছে তারা হয়তো মনে করতে পারবেন রেডিও বা দূরদর্শনে কোন একটা অনুষ্ঠান চলাকালীন হটাৎ মধ্যিখানে সেটি কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যেত আর টিভি স্ক্রিনে ফুটে উঠত ‘অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় আমরা দুঃখিত’ আর রেডিওতে সেই একই ঘটনা ঘটলে ‘আনন্দশঙ্কর, ভি বালসারা অথবা অলকনাথ দে’-র কম্পজ করা কোন ফিউশন মিউজিক পিস শোনান হত যাতে সেই সময় তৎকালীন টেকনিশিয়ানরা সেই ফিউশন মিউজিকের আড়ালে চেষ্টা করতেন পরিস্থিতি সামাল দেবার । হয়তো সেই সময় মূল অনুষ্ঠানের স্পুল টেপের ফিতে জড়িয়ে গেছে মেশিনে আর শ্রোতাদের সামনে ফিউশন মিউজিক নামক এক শিখণ্ডীকে সামনে রেখে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া হত ।  তারপর একসময় আবার সেই মূল অনুষ্ঠান শুরু হত । 
    এই প্রানান্তকর অবস্থা অনেকদিন চলার পর স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এগিয়ে এলেন এর সমাধান নিয়ে ।  ৮০ এর দশকে কোলকাতায় ‘অ্যাডমেকার্স’ নামে একটি সংস্থা গড়ে ওঠে অরূপ গুহ ঠাকুরতার হাত ধরে ।  এই অরূপ গুহ ঠাকুরতার স্ত্রী ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ও অভিনেত্রী রুমা গাঙ্গুলি এবং আমরা অনেকেই জানি বোম্বাই-এ কিশোরকুমারের সাথে বিচ্ছেদ হবার পর রুমা এই অরূপ গুহ ঠাকুরতাকে বিয়ে করেন ।  আর রুমা ছিলেন সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের ভাগ্নি ।   সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরে ঠিক হোল বিবিধ ভারতীতে ‘অ্যাডমেকার্স’ তার যাত্রা শুরু করবে সত্যজিৎ রায়ের একটি গোয়েন্দা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে । একটি বানিজ্যিক সংস্থার হয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের সাথে সাথে এই নাটকটির বেতার নাট্যরূপ অভিনীত হবে । খবরের কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপিত হোল ‘বিবিধ ভারতীতে এই প্রথম সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চচার – গোঁসাইপুর সরগরম । এই প্রথম সত্যজিৎপুত্র শ্রীমান সন্দীপ-এর নাট্যরূপ ও নির্দেশনা । ফেলুদার চরিত্রে সন্তু মুখোপাধ্যায় ও লালমোহনের চরিত্রে সন্তোষ দত্ত তৎসহ সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি, কামু মুখার্জি ও আরও অনেকে ।  কয়েকটি এপিসোডের রেকর্ডিং হোল ‘অ্যাডমেকার্স’ স্টুডিয়োতে অরূপ গুহ ঠাকুরতার তত্বাবধানে ।  
কিন্তু গণ্ডগোল বাধল ব্রডকাস্টের দিন রবিবার সকাল সাড়ে এগারটায় ।  নাটক চলাকালীন রেডিওতে শোনা যেতে লাগলো নানারকম ভুটভাট, কিচকিচ শব্দ ।  শেষে এমন অবস্থা হোল যে নাটকের ফেলুদারূপি সন্তু মুখোপাধ্যায়ের সংলাপগুলোই ঠিকমতো বোধগম্য হল না ।  পরের রবিবার অর্থাৎ সেই নাটকের দ্বিতীয় এপিসোডও সেই একই অবস্থা । একটা সময় এমন হোল যে বিবিধ ভারতীর অত্যন্ত বাজে সম্প্রচারের জন্য সেই এপিসোডটাও ঠিক মতো শোনা গেল না ।   ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল পরের রবিবার অর্থাৎ নাটকের তৃতীয় এপিসোডের অতি বদখত সম্প্রচারের সময় ।  আকাশবাণীর কেন্দ্র অধিকর্তার কাছে একটি টেলিফোন এল। অধিকর্তা হ্যালো বলতেই টেলিফোনের অপর পাশ থেকে একটা জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল “আমি সত্যজিৎ রায় বলছি, বিশপ লেফ্রয় রোড থেকে । এসব কি হচ্ছে গত কয়েকসপ্তাহ ধরে। সকাল এগারটা থেকে সাড়ে এগারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠানটা রেডিওতে ঠিক মতো শোনা গেল, দুপুর বারটা থেকে সাড়ে বারটার অনুষ্ঠানটাও ঠিকঠাক তাহলে সাড়ে এগারটা থেকে বারটার অনুষ্ঠানটার সম্প্রচারে এত গণ্ডগোল কেন ? এটা কি আপনাদের ইচ্ছাকৃত ? আপনি শীগগির ব্যবস্থা নিন নয়তো আমি কিন্তু আইনি ব্যবস্থা নেব ।”
ব্যাস শুরু হয়ে গেল আকাশবাণী ভবনে তুমুল হুলুস্থুলু ।  কি হয়েছে যার জন্য সত্যজিৎ রায়ের মতো ব্যাক্তিত্ব ফোন করছেন ।  সম্প্রচারে এত পার্থক্য হচ্ছে কেন ?  ব্যাপারটার তদন্ত শুরু হতেই ধরা পড়ল একটা বিশাল গলদ ।  আসলে বিবিধ ভারতীতে যেসব টেপরেকর্ড প্লেয়ার মেশিনে এইসব বিজ্ঞাপন নাটকগুলো শোনানো হয় তাদের গুনমান এক নয় । কোনটা নূতন কোনটা বেশ পুরোন আর সেগুলি থেকেই গণ্ডগোলের সুত্রপাত ।  সেই পুরোন মেশিনগুলোতে যে টেপগুলো বাজে সেগুলো চলতে চলতে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রায়শই । তখন একটা ফিলার মিউজিক বাজিয়ে শ্রোতাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কতৃপক্ষ দায় এড়ান এবং সেটা বিবিধ ভারতীর জন্মলগ্ন থেকেই চলছে কিন্তু প্রতিবাদ করার কারও সাহস নেই । 
সত্যজিৎ রায়ের হস্তক্ষেপে বিবিধ ভারতীর পুরোন টেপ মেশিনগুলো বাতিল হল আর সেই জায়গায় এল সেই সময় উপযোগী নতুন টেপ প্লেয়ার মেশিন ।   রবিবারের অনুষ্ঠানগুলি এবার যথাসম্বভ কম ত্রুটি নিয়ে বাজতে থাকল ।  কিন্তু সত্যজিৎ রায় সেখানেই থেমে থাকলেন না । তিনি অরূপ গুহ ঠাকুরতা ও বিবিধ ভারতীর কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে আগের সমস্ত এপিসোড বাতিল করলেন এবং বন্ধ হয়ে গেল ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ –এর বেতার সম্প্রচার । এবার তিনি নিজে তাঁর আর একটি ফেলুদা উপন্যাসের বেতারনাট্যরূপ করার জন্য উদ্যোগী হলেন ।    ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ –এ সন্তু মুখোপাধ্যায় অভিনীত ফেলুদা কেমন হয়েছিল জানি না তবে এই সময় সত্যজিৎ রায় ফেলুদারূপে হাজির করলেন তাঁর বড় পর্দার ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এবং সেটিই সৌমিত্রবাবুর প্রথম বেতার অভিনয় ।  নাটকে অভিনয় করার জন্য  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় ডেকে নিলেন বিকাশ রায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়,   এন বিশ্বনাথন, সুশীল মজুমদার, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, কামু মুখার্জি, সন্তোষ দত্ত, সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি, রুমা গুহঠাকুরতা  প্রমুখ শিল্পীদের ।  সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সেই নাটক খুব যত্ন করে রেকর্ডিং করে নিলেন ‘অ্যাডমেকার্স’ স্টুডিয়োর অরূপ গুহ ঠাকুরতা ।   তারপর একদিন কলকাতা ‘ক’ প্রচার তরঙ্গে সম্প্রচারিত হল “বাক্স রহস্য” ।  এর পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা ‘ক’ প্রচার তরঙ্গে আমরা শুনেছি ফেলুদার আর একটি রহস্য উপন্যাস “রয়েল বেঙ্গল রহস্য” এর নাট্যরূপ যেখানে ফেলুদার ভূমিকায় ছিলেন গৌতম চক্রবর্তী, জটায়ুর ভূমিকায় ছিলেন ধীমান চক্রবর্তী আর গল্পের সুত্রধার অর্থাৎ তপেশরঞ্জনের ভূমিকায় ছিলেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায় ।      
আজও ইউটিউবে সার্চ করলে রেডিও মির্চিতে সম্প্রচারিত ফেলুদা গল্পের নাটক ছাড়াও এই নাটকগুলি হয়তো পেয়ে যেতে পারেন । আজ সত্যজিৎ রায়ের ১০০ তম জন্মদিন । তাহলে আজ কয়েকটা ফেলুদা গল্পের নাট্যরূপ শুনে নিন তাহলে ।

প্রবীর মিত্র 
০২/০৭/২০২০