Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০

সংগীতের কিংবদন্তী

 বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি

 

[গত ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ছিল গানের প্রতিমার ৮৬ তম জন্মদিন।  শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগীতবহুল জীবনের কিছু কথা, আজ অন্তিম পর্ব।  প্রথম পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন ]


গত পর্বের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের ছবিতে গাওয়া নানা ধরনের গান। আজ এই পর্বে চেষ্টা করছি ওনার বাংলা আধুনিক গান ও অন্যান্য গান নিয়ে কিছু লেখার।  আগেই লিখেছিলাম প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড ১৯৪৫-৪৬ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয় সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি থেকে কুমারী প্রতিমা চ্যাটার্জি  নামে । সুকৃতি সেন-এর সুরে গান দুটি ছিল ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’ ও ‘প্রিয় মালাখানি দিয়ে’।  এরপর বেশ কিছু বছর বিরতি নিয়ে ১৯৫২ সালে এইচ এম ভি –এর ব্যানারে প্রতিমা গাইলেন ‘হায়, আমার যে ঘর ছিল, হায়রে কে তা কেড়ে নিল’।  রেকর্ড কভারে মোহিনী চৌধুরীর লেখা এই দীর্ঘ গানটির উল্লেখ ছিল ‘শিল্পী প্রতিমার গাওয়া একটি বাস্তবগীতি’।  কে বলতে পারে এই বাস্তবগীতিই হয়তো বা অনেকপরের জীবনমুখী গান।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘আমার সোনা চাঁদের কণা’ গানটি একসময় গ্রামবাংলার মায়েদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।  নিজের বাচ্ছাকে আদর করতে করতে অনেক মা-ই এই গানটি গুনগুন করে গাইতেন একটা সময়। ১৯৫৩ সালে রিলিজ হওয়া এই গানটির কথা লিখেছিলেন প্রনব রায় ও সুর দিয়েছিলেন নিতাই ঘটক । অপত্য স্নেহ প্রতিমার গলায় যেন মধু হয়ে ঝরেছিল এই গানের মধ্য দিয়ে। ১৯৫৫ সালে সলিল চৌধুরী গাওয়ালেন, ‘নাও গান ভরে নাও প্রাণ ভরে’ । এই গানের মধ্যে সলিলবাবুর গানে ব্যবহৃত সেই সময়কার খুব পরিচিত কয়েকটি বিশেষণ যেমন – সোনার ধানের শিষ, প্রান্তর, ঝির ঝির বাতাস , ঝিঁঝিঁ ডাকা দুপুর, সোনা রঙ আকাশের বর্ণনা, পল্লীবধূর কঙ্কণ শব্দ ইত্যাদি খুব সুন্দরভাবে লিখেছিলেন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় যা প্রতিমার গলায় একেবারে যথাযথ আর বলাই বাহুল্য গানের সুরকার সলিল চৌধুরী।   এই গানের জনপ্রিয়তার উপর ভর করে ১৯৫৬ সালে ‘দিয়ালি কি রাত’ ছবিতে তালাত মেহমুদ গাইলেন, ‘ইয়ে খুশী কা সামা’ যার মুখরাটা তিনি নিয়েছিলেন প্রতিমার এই গানটি থেকে। গানের সুর দিয়েছিলেন স্নেহাল ভাটকর। 


           

সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রতিমা বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন তার মধ্যে আজও এক নম্বরে ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’।  আমার ব্যক্তিগত মতে এটা প্রতিমাদেবীর একটা অমরগীতি, এক দিদিকে খুঁজে চলা এবং সেই অনন্ত খোঁজ শেষ না হবার একটা উপখ্যান বা কাব্যসঙ্গীত।  তখন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’, ‘রানার’ বা ‘পাল্কীর গানের’ মতো কাব্যসঙ্গীত হাতে গোনা। পঞ্চাশের দশকে কবির কবিতায় সুরারোপের যে ধারা চলছিল সেটা মাথায় রেখে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর একটি কবিতা বেছে নিলেন।  গানটি প্রতিমা পর পর দুই বার রেকর্ডিং করছিলেন ।  দ্বিতীয়বার রেকর্ডিং –এ আসে নতুন যন্ত্রানুসঙ্গ কিন্তু গানের ভঙ্গিমা অবিকল সেই প্রথমে করা রেকর্ডিং এর মতো। ‘মাগো আমার শোলোক বলা কাজলাদিদি কই?’ – এই খোঁজের আর্তি আজও প্রত্যেক সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের চোখে জল এনে দেয়।  গান প্রকাশের বেশ কিছুদিনের মধ্যে প্রতিমার বাড়ীতে আসতে থাকল ফ্যান লেটার। এতদিন যেটা হয় নি, বিভিন্ন জায়গায়, অনুষ্ঠানে বা জলসায় প্রতিমার সই নেবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।  প্রত্যেকটা জলসায় প্রতিমাকে গাইতে হল সেই মর্মস্পর্শী গানখানি।  আরও একটি গান মনে পড়ছে লিখতে গিয়ে, ‘এ

সুরের প্রতিমা

পারে গঙ্গা ও পারে গঙ্গা মধ্যিখানে চর, ভাস্কর বসুর কথায় এই গানেরও সুর দিয়েছিলেন সুধীনবাবু, গানের একটা লোকায়ত মেজাজকে গলার মধ্যে ধরেছিলেন প্রতিমা।   সুধীন দাশগুপ্তের সুরে আরও বেশ কয়েকটি বেসিক গান প্রতিমার কণ্ঠে বেশ হিট করেছিল, ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, ‘সাতরঙা এক পাখী’, ‘নিভে যা রাত নিভে যা’, ‘প্রেম শুধু এক মোমবাতি’, তোমার দেয়া অঙ্গুরীয়’ ইত্যাদি সব কালজয়ী গান।    

গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে তাঁর লেখা প্রথম বেসিক গান প্রতিমাদির গাওয়া, সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।  গানটি ছিল, ‘তোমার দুচোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’।   অভিজিৎবাবুর কথায় জানা যায়, ‘শুদ্ধ ‘গা’ দিয়ে শুরু করে বা এর উপর বেস করে কত গানের যে সুর করেছি, কিন্তু এমন তো হয়নি, এই গানে প্রতিমাদি তাঁর অদ্ভুত একটা ‘ইনোসেন্ট’ গলায় গান শুরু করতেই সব কিছু যেন একটা অন্য চেহারা নেয়’।  ‘ইনোসেন্ট গলা’ এর চেয়ে ভালো ভাবে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠের ব্যাখ্যা কেউ কোনদিন দিতে পেরেছেন কিনা জানা নেই।  অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে আরও একটি গানের কথা মনে পড়ছে, ‘ওই আকাশে ক্লান্তি নেই’ গানে (১৯৬৩),  গানের কথা লিখেছিলেন অমিয় দাশগুপ্ত।

সুরকার নচিকেতা ঘোষ সুর নিয়ে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেন। পুলক

 ইনোসেন্ট ভয়েসের প্রতিমা

বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘মেঘলা ভাঙ্গা রোদ উঠেছে’ গানটিতে এমনভাবে সুর করলেন যেখানে ছন্দের ঝোঁক সব সময় দ্বিতীয় শব্দের উপর পড়ে।   ১৯৫৮ সালের শারদীয় পুজোর উপহার হিসাবে প্রতিমা এই গানটি গাইলেন, এরপর পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা পেয়েছি, ‘ছল্কে পড়ে কল্কে ফুলে’ (কথা- প্রবোধ ঘোষ, সুর- অনল চট্টোপাধ্যায়), ‘মন যে খুশী খুশী আজ’(কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর-রতু মুখোপাধ্যায়), ‘আর তো পারি না সহেলি’ (কথা-মিল্টু ঘোষ, সুর-অনল চট্টোপাধ্যায়), ‘আমি পিয়া হব ছিল সাধ’ (কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর-রবীন চট্টোপাধ্যায়), ‘তুমি চোখের সামনে ধর পঞ্চমীর চাঁদ’ (কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর-মান্না দে) ইত্যাদি সব গান আজও সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতাদের মনকে বিশেষভাবে ছুঁয়ে যায়।  তবে আমার একান্ত ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয় ‘তুমি চোখের সামনে ধর পঞ্চমীর চাঁদ’ আধুনিক গানটি মান্না দে-র সুরে একমাত্র গান যেটি প্রতিমা গেয়েছিলেন।   ভূপেন হাজারিকার সুরে আরও একটি জনপ্রিয় গান ‘তোমায় কেন লাগছে এতো চেনা’, প্রতিমা এতো সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছিলেন যা সেইসময়কার অন্যান্য জনপ্রিয় রোম্যান্টিক গানের মধ্যে অন্যতম স্থান করে নিয়েছিল।  অনেকপরে ১৯৯৭ সালে এই জনপ্রিয় গানটি আবার হিন্দিতে রিমেক করেন গানের সুরকার ভুপেন হাজারিকা। কল্পনা লাজমির ‘দরমিয়ান’ ছবিতে ভূপেনবাবু নিজে হিন্দি ভার্সনটি গেয়েছিলেন এবং সেই সময় বলিউডের প্রথম ১০টি গানের মধ্যে ছিল এই গানটি।  

বাঙ্গালীর মন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো বোধ হয় আর কেউ বুঝতেন না, ফলে যখনই সুর করেছেন সেই গান খুবই পপুলারিটি পেয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘আঁধার আমার ভালো লাগে’ (কথা – মুকুল দত্ত), ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’ (কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) এই গানদুটি হৃদয় দিয়ে পরিবেশন  প্রতিমা আর এর সাথে সাথেই হেমন্তবাবুর সঙ্গে প্রতিমার খুব সুন্দর একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৫৮ সালে ‘সাহারা’ নামে একটি হিন্দি ছবিতে প্রতিমাকে দিয়ে হিন্দি গান রেকর্ড করেন হেমন্তবাবু। গানটি ছিল মীনাকুমারীর লিপে।  গানটি গেয়ে মুম্বাইতে বেশ প্রশংসা পেয়েছিলেন প্রতিমা।  বেশ কয়েকদিন মুম্বাইতে হেমন্তবাবুর কাছে থাকার পর প্রতিমা কোলকাতায় ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন, কারণ কোলকাতার বাড়ীতে তখন তাঁর দুই শিশুপুত্রকন্যা, অশোক ও রাইকিশোরী।  বাচ্ছাদের টানে, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত-এর মতো শিল্পীদের সমস্ত অনুরোধকে পিছনে ফেলে প্রতিমা আবার কোলকাতায় ফিরলেন।  ১৯৬৯ এ ‘প্রসাদ’ পত্রিকার হেমন্তসংখ্যায় প্রতিমা লিখেছিলেন, ‘দুটি গান সুর দিয়েছি,  খুব ইচ্ছে ছিল আমার গানের দাদা, হেমন্তদা সেই দুটি গান রেকর্ড করুক।  আমার ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন দাদা অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে । ১৯৫৮ সালে আমার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে দাদা আমার সুরে ও দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের কথায় রেকর্ড করেন দুটি গান, ‘তন্দ্রাহারা রাত ওই জেগে রয়’, ‘শেষের কবিতা মোর দিয়ে যাই আজ’।   ‘গোলাভরা ধানের মতোই হেমন্তর ছিল গলাভরা গান’, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের  এই কথা যেন আরও একবার প্রমান করে দেয় এই গানদুটি শুনলে।    

রেডিও-এর রম্যগীতি অনুষ্ঠানে নিয়মিত শিল্পী ছিলেন প্রতিমা। রেকর্ডে আধুনিক ছাড়াও গেয়েছেন খেয়াল, ঠুংরি, কীর্তন, ভজন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদ, নজরুলগীতি এবং লালন ফকিরের গান। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ১৯৭৫ সালে এইচ এম ভি থেকে পুজোয় প্রকাশিত একটি বিখ্যাত লালনগীতি, ‘এ বড় আজব কুদরতি’।   ছোটবেলায় রেডিওতে শোনা ‘তুষারমালা ও সাতটি বামনভাই’ গীতিনাট্যে তুষারমালার স্নেহময়ী  মায়ের অসাধারন গীতিকণ্ঠে ছিলেন প্রতিমা।  প্রতিমার সমসাময়িক অন্যান্য শিল্পীবন্ধুদের মধ্যে ছিলেন গায়ত্রী বসু, নির্মলা মিশ্র, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, উৎপলা সেন প্রমুখ । মেয়ে রাইকিশোরীর কথায় জানা যায়, বিভিন্ন শিল্পীর পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রতিমার সবসময় উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকত।  বিদেশে প্রচুর অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও  বিমানে চড়তে হবে এই ভয়ে প্রচুর অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতেন প্রতিমা। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ, হয়তো নাড়ীর টান।    ১৯৮৬ সালে প্রতিমার স্বামী অমিয় বন্দোপাধ্যায় মারা যাবার পর প্রতিমা বড্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। আস্তে আস্তে কমিয়ে দেন সমস্ত রেকর্ডিং।   বছর দশেক তাঁকে জলসায় তেমন আর পাওয়া যায় নি।  এর মাঝে গাথানি থেকে প্রকাশিত একটা ক্যাসেটে প্রতিমা গাইলেন কিছু আধুনিক গান। এরপর নির্মলা মিশ্রের চেষ্টায় ১৯৯৬ সালে রবীন্দ্র সদনে ‘এসোসিয়েশন অব প্রফেশনাল পারফরমিং সিঙ্গারস’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রতিমা কয়েকটি সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তাছাড়া বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও তাঁর মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে আরও অসহায় করে তোলে।  শেষের দিকে কাউকে চিনতে পারতেন না প্রতিমা।  ফ্যালফ্যাল করে অসহায়ভাবে শুধু মানুষ চেনার চেষ্টা করতেন।   দিদি প্রতিমার জীবনের

জীবনের অন্তিম লগ্নে প্রতিমা

এই অসহায়তার দিনে নির্মলা মিশ্র সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করতেন।   সময় পেলেই নির্মলা চলে যেতেন প্রতিমার সাহানগরের বাড়ীতে।    খালি গলায় প্রতিমাকে শোনাতেন বিভিন্ন ধরনের গান।   অনেক সময়, প্রতিমার নিজস্ব গান, প্রতিমা সেইসময় ফ্যালফ্যাল করে নির্মলার দিকে তাকিয়ে থাকতেন, হয়তো প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতেন সেই সব ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। অবশেষে ২৯শে জুলাই, ২০০৪ সালে সমস্ত যন্ত্রণার অবসান।  প্রতিমার ইনোসেন্ট গলার স্বর চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। সম্পূর্ণ শিল্পী বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। তাঁর কালজয়ী গানগুলো আজও সমস্ত গানপাগল লোকেদের মনকে টাইমমেশিনে নিয়ে যায় সুদূর অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিতে।   প্রতি বছর সঙ্গীতমেলা অথবা দূরদর্শনে রিয়ালিটি শো-তে প্রতিমার গানের ব্রাত্যতা যেন বাংলা সঙ্গীতপ্রেমী মানুষকে বড্ড বেশী পীড়া দেয়।      


 

আমার সোনা চাঁদের কনা


 
 
নাও গান ভরে নাও প্রাণ ভরে 
 
 
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই - প্রথম রেকর্ডিং 
 
 
শেষের কবিতা মোর দিয়ে যাই আজ - প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের সুরে হেমন্তবাবুর গাওয়া একটি দুর্লভ গান
 
 

তথ্যসুত্রঃ- সা রে গা পত্রিকা, গানের প্রতিমা - স্বপন সোম – আনন্দবাজার পত্রিকা, গানের ভুবন - নবপত্রিকা, বাংলা গানের স্বর্ণযুগ – প্রসাদ পত্রিকা, আনন্দধারা – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মনে পড়ে – তপন সিনহা ও গানের সমস্ত লিংক ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত।   

 

প্রবীর মিত্র

২৯/১২/২০২০

 
 
 

রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০

সংগীতের কিংবদন্তী

 

বাংলা গানের সাতরঙা এক পাখী

 [আগামীকাল ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০, বেঁচে থাকলে চির আঁধারে থেকে যাওয়া এই কিন্নরকণ্ঠী এই দিনে ৮৬ বছরে পদার্পণ করতেন।  শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগীতবহুল জীবনের কিছু কথা, আজ প্রথম পর্ব।] 

 

 ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি কোন এক রাত, নবাগতা শিল্পী নির্মলা মিশ্রের বাড়ীতে একটি ফোন এল । ওপারে আর এক শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।  তখন নির্মলা মিশ্র সবে একটু আধটু গান গেয়ে নামডাক করেছেন । প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন সিনিয়র শিল্পীর ফোন পেয়ে নির্মলা বেশ ঘাবড়ে গেলেন। প্রতিমা জানালেন তিনি একটি গান নির্মলার সাথে রিহার্সাল করতে চান ফোনের মাধ্যমে কারণ তিনি সারাদিন একদম সময় পাচ্ছেন না অন্যসব রেকর্ডিং-এর জন্য ।  গানটি হোল ‘আবিরে রাঙ্গালো কে আমায়’ । শ্যামল গুপ্তের লেখা এই গানটি সুরকার মানবেন্দ্রবাবু মনে করছেন এই গানটি ডুয়েট হবে আর গাইবেন প্রতিমা ও নবাগতা নির্মলা ।   কিন্তু প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছুতেই আর সময় হয় না রেকর্ডিং এর আগে একসঙ্গে বসে রিহার্সাল করার, তাই এই ফোন ।  নির্মলা মিশ্রের এক স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, এতটাই গানের প্রতি ডেডিকেশন ছিল প্রতিমাদির, সেইসঙ্গে নিয়মিত রিহার্সালে সময় করতে না পারার কুণ্ঠাবোধ ।  অবশেষে, টেলিফোনেই গানের প্রায় সিংহভাগ রিহার্সাল হয়ে গেল ।  তারপর মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে রেকর্ডিং হোল সেই রাগাশ্রয়ী ডুয়েট গান যা নির্মলা মিশ্রকে অনেকটা প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে, এর জন্য নির্মলা আজও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি ।  এই গানটি পরে ‘মুখুজ্জে পরিবার’ ছবির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল ।        

     

কিশোরী প্রতিমা
 

২১ শে ডিসেম্বর ১৯৩৪ সালে প্রতিমার জন্ম হয় কলকাতার টালিগঞ্জে মামার বাড়ীতে । তার আগে অবশ্য তাঁরা থাকতেন বাংলাদেশের বাহেরক গ্রামে । বাবা মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় শুধু সংগীতপ্রেমী বললে ভুল হবে, রীতিমত সংগীতচর্চা করতেন তিনি । কে.এল. সাইগল, শচীনদেব বর্মণের মতো গুণীরা ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু । মা কমলাও খুব ভালো গান গাইতেন । মায়ের প্রেরনাতেই সুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ছোটবেলায় মা যখন রান্না করতেন তখন ছোট্ট প্রতিমা উনুনের পাশে বসে চুপটি করে মায়ের গান শুনতেন।  কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মাত্র ২৭ বছর বয়েসে বাবা মণিভূষণ ইহলোক ত্যাগ করলেন । স্বামীহারা কমলা মেয়ে প্রতিমাকে নিয়ে নতুন এক জীবনসংগ্রামে ঝাঁপ দিলেন।  বাবা-মা দুজনেই চেয়েছিলেন মেয়ে যেন গান শেখে, গানে বড় হয়।   এই সময় এগিয়ে এসেছিলেন বিশিষ্ট সংগীত-শিক্ষক প্রকাশকালী ঘোষাল । পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আবার প্রকাশকালী ঘোষালের সংগীতগুরু ।  প্রতিমার সংগীত প্রতিভাতো ছিলোই এবার সেটাতে শান দিতে শুরু করলেন প্রতিমার গুরু প্রকাশকালীবাবু ।  প্রতিমাকে শেখাতে লাগলেন বিভিন্নধরনের রাগাশ্রয়ী ভজন।

অবশেষে সুযোগ এল ১৯৪৫-৪৬ সাল নাগাদ, প্রতিমার প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হল কুমারী প্রতিমা চ্যাটার্জি  নামে সেনলা কোম্পানি থেকে, বেসিক গান, ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’, ও ‘প্রিয় মালাখানি দিয়ে’, সুকৃতি সেন-এর সুরে  । ইতিমধ্যে বিভিন্ন জলসায় তিনি গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন । জৌনপুরি রাগের উপর ‘নন্দদুলাল নাচে’ ও ‘প্রদীপ কহিল দখিনা সমীরে’ গানদুটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর কণ্ঠে যে গানটি তাঁকে বিভিন্ন জলসায় বারংবার গাইতে হত।   এইরকম একটি জলসাতেই প্রতিমার সাথে আলাপ হল সংগীতপ্রেমী সুদর্শন যুবক অমিয় বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং কিছুদিনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তিনি । এবার প্রতিমা, চট্টোপাধ্যায় থেকে হলেন বন্দ্যোপাধ্যায় ।          

দক্ষিণ কলকাতার মিলনচক্র নামে একটি ক্লাবে প্রায়ই উদ্যোক্তারা জলসার আসর বসাতেন এবং সেখানে আসতেন বিশিষ্ট সব সংগীত শিল্পীরা ।   সেখানে প্রতিমার গান শুনে সেই সময়কার এক বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ও সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তীর বেশ ভালো লেগে গেল।  ১৯৫১ সালে ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে তিনি প্রতিমাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’ এবং সেটাই প্রতিমার প্রথম ফিল্মে প্লেব্যাক।  গানটি খুব জনপ্রিয় হল ।  সুধীরলালের ছিল জহুরীর চোখ, গানের জন্য ঠিক লোককেই তিনি বেছেছিলেন।  তবে প্রতিমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল পিনাকী মুখোপাধ্যায়েরঢুলিছবিটি। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্তঢুলিছিল তখনকার দিনের মাল্টিস্টারার, মিউজ়িক্যালি হিট ছায়াছবি। ছবির সুরকার ছিলেন বিখ্যাত ক্লারিওনেট বাদক রাজেন সরকার ।  ছবি বিশ্বাস, সুচিত্রা সেন, অনিল চট্টোপাধ্যায়, মালা সিনহার অভিনয়ে সমৃদ্ধ এই ছবির টিকিট কাটতে হলে যে দীর্ঘ লাইন পড়ত, তারই দর্শক মোহাবিষ্টের মতো সিনেমা শেষে বেরিয়ে আসতেন রাজেন সরকারের সুরে অনবদ্য গানগুলি গুনগুন করতে করতে।  ঢুলি রেকর্ড সেইসময় বিক্রি হয়েছিল মুড়ি-মুড়কির মতো।  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, যূথিকা রায়ের মতো জনপ্রিয় শিল্পীদের পাশে চমকে দিয়েছিলেন নবীনা প্রতিমা।  রাজেন সরকার ছবির জন্য একটি ডুয়েটগানে প্রতিমাকে নির্বাচন করেছিলেন চুপি চুপি এল কেগানে । পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ গাইয়ে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে  এই গানে সমানে পাল্লা দিলেন প্রতিমা এবং এই ছবিতেই নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন অপর একটি গানে, নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে   রাগাশ্রিত এই গানটি প্রতিমার চিকন গলায় একেবারে পারফেক্ট ।  কত না সুক্ষ্ম অলংকরণ প্রতিমা সহজাত নৈপুণ্যে ও মাধুর্যে ফোটালেন অথচ কখনই তা জাহির করা নয় । মালা সিনহার লিপে এই গানে প্রতিমা তাঁর রাগের যে ছোট ছোট কাজ গলায় তুলেছিলেন, তা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।   তাঁর অস্ফুট জিজ্ঞাসারই প্রতিধ্বনি উঠেছিল সেই সময়ের তাবড় সঙ্গীতকুলে। এই   শ্রীকণ্ঠী কে  

এর ঠিক পরের বছর ১৯৫৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর সুরারোপিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘শাপমোচন’ ছবিতে প্রতিমাকে চিন্ময় লাহিড়ীর সঙ্গে গাইবার সুযোগ করে দিলেন।  ‘ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’, এই রাগাশ্রয়ী গানটি রেকর্ডিং সময় সবাই অবাক হয়ে দেখল, যেখানে চিন্ময় লাহিড়ী তাঁর গানের সময় তালের ওঠানামায় হাতের মুদ্রার ব্যবহার সেখানে প্রতিমা মূর্তিবৎ ধীরস্থির । শুধু গানের জন্য তাঁর ঠোঁটটুকু নড়ছে ।   ছবিতে এই গানের লিপে ছিলেন অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন।  এই গানে লিপ দেওয়াও ছিল বেশ কঠিন কাজ, তাই বারবার প্রতিমার সাহানগরের বাড়িতে চলে আসতেন মহানায়িকা,  যেখানে নাকি দিবারাত্র রেওয়াজে ডুবে থাকেন মহাগায়িকা।    প্রতিমার কাছে তিনি প্রায়ই আবদার করতেনযদুভট্টছবিরবাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়গানটি শোনাতে।  ১৯৫৪ সালে, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সংগীত পরিচালনায় ‘যদুভট্ট’ ছবিতে প্রতিমা এই গানটি গেয়েছিলেন এবং তাতে ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত সাংগীতিক সরলতা।   এই গানের জন্য তিনি প্রথমবার বি এফ জে (Bengal film journalist) পুরস্কারে ভূষিতা হয়েছিলেন।   প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নবাব ওয়াজ়িদ আলি শাহের হৃদয়ের ভিতর থেকে উঠে আসা এই গানটিতে যুগে যুগে সেরা শিল্পীরা কণ্ঠদান করেছেন। বেগম আখতার, কুন্দনলাল সায়গল, গিরিজা দেবী, ভীমসেন জোশি, জগজিৎ সিংহ সকলেরই সেরা অ্যালবামে এই ভৈরবী-ঠুমরি থাকবেই।

১৯৬০ সালে প্রতিমা গাইলেন ‘মুরলী বাজে প্রেম-বৃন্দাবনে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘গরীবের মেয়ে’ ছবির জন্য ।  অসাধারন জনপ্রিয় আর একটি গান । ওই একই বছরে সুযোগ এল তপন সিনহা পরিচালিত ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে গান গাইবার জন্য ।  সংগীত পরিচালক আলি আকবর খানকে তপন সিনহা অনুরোধ জানালেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি গানের সুর এই ছবিতে ব্যবহার করতে চান ।  ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গল ঝড়ে’ এই গানের সুরের উপর ভিত্তি করে ছবির সুরকার আলি আকবর খান সৃষ্টি করলেন বিখ্যাত গান ‘ক্যায়সে কাটে রজনী ইয়ে সজনী’ । পণ্ডিত আমীর খান সাহেবের সাথে যোগ্য সঙ্গত করলেন প্রতিমা এবং গানের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতটি গাইলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।   এর ঠিক পরের বছর প্রতিমা আবার ডাক পেলেন তপন সিনহার কাছ থেকে ‘ঝিন্দের বন্দী’ সিনেমায় গান গাওয়ার জন্য। আলি আকবর খানের সুরে প্রতিমা এবার একটি সোলো গান গাইলেন, ‘মে হো গেয়ি দিওয়ানি’ ।  

প্রতিমা শুধু রাগনির্ভর সঙ্গীতে থেমে থাকেন নি। ভক্তিরসাত্মক গান, অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি, লোকায়ত গান, আধুনিক রম্যগীতি সবেতেই মুক্তো ছড়িয়েছেন। পঞ্চাশের দশক থেকেই তিনি এইচএমভি- আর্টিস্ট। ১৯৬৯ এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রতিমার সেই বিখ্যাত কীর্তন আঙ্গিকের গান ‘কুসুম দোলায় দোলে শ্যামরায়’ অথবা এর পাশে অতুলপ্রসাদ সেন-এর লেখা সেই হৃদয়স্পর্শী গান, ‘সংসারে যদি নাহি পাই সাড়া’ গানদুখানি আজও সমস্ত সংগীতপ্রেমীদের মন ছুঁয়ে যায়।   অপরদিকে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ ছবিতে প্রতিমার কণ্ঠে ‘মাধব বহুত মিনতি’ এবং ‘কি রূপ দেখিনু’ কে ভুলতে পারে। ১৯৬০ সালে  ‘নুতন ফসল’ ছবিতে রাইচাঁদ বড়াল ও বিলায়েত খানের যুগ্ম সংগীত পরিচালনায় তিনি গাইলেন লোকায়ত গান, ‘আমার যেমন বেনী তেমনি রবে’ এবং নির্মলেন্দু চৌধুরীর সাথে ডুয়েট ‘ওই মানুষকে চিনবি কেমনে’ অথবা আরও একটি জনপ্রিয় গান ‘সাধ করে পুষিলাম ময়না’ সেই সময়ের খুব জনপ্রিয় গান।

রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘মায়ার সংসার’ ছবিতে ১৯৬২ সালে প্রতিমা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাইলেন ‘আমার প্রভাত মধুর হল’। গানতো নয় যেন পুজোর নৈবেদ্য, যারা শুনেছেন তাঁরাই একবাক্যে স্বীকার করবেন এই কথাটা।   বহুকাল আগে আঙ্গুরবালা দেবী ধীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ও ভূতনাথ দাসের সুরে গেয়েছিলেন ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’ এবং ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’ (কথা বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত) ।  ১৯৬৭ সালে প্রতিমা সেই গানের রিমেক করলেন পুরোপুরি নিজের মতো করে ‘ছুটি’ ছবির জন্য অরুন্ধুতী দেবীর সংগীত পরিচালনায়। পরবর্তী বছর প্রতিমার কাছে অনুরোধ এল ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে একটি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার জন্য। অসীমা ভট্টাচার্যের সংগীত পরিচালনায় তিনি গাইলেন ‘এই কথাটি মনে রেখো’।   অবশ্য এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, ১৯৫৩ সালে প্রতিমা ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ ছবিতে উৎপলা সেন ও অন্যান্যদের সাথে গেয়েছিলেন তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসংগীত, ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে’।  ‘ছুটি’, ‘চৌরঙ্গী’ ও ‘পরিণীতা’ ছবির গানগুলির জন্য প্রতিমা পর পর তিন বছর বি এফ জে পুরস্কারে ভূষিতা হয়েছিলেন।   ১৯৭০ সালে ভুপেন হাজারিকা ‘এখানে পিঞ্জর’ ছবির  প্রতিমাকে দিয়ে অতুলপ্রসাদের একটি জনপ্রিয় গান রেকর্ডিং করালেন ‘একা মোর গানের তরী’ ।  এই গানের মাধ্যমে প্রতিমা আরও একবার প্রমান করে দিলেন তিনি একজন জাত শিল্পী।    

এরপর তিনি বেশ কিছু ছবিতে গান গেয়েছেন যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সিঁথির সিন্দুর, প্রিয়া, হ্রদ, অন্তরীক্ষ, সোনার কাঠি, নদের নিমাই, বিপাশা, আলো আমার আলো, হীরে মানিক ইত্যাদি ছবি।   ‘এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব সেই চাঁদের পাহাড় দেখতে পাব’, হীরে মানিক ছবির এই গানটিতে প্রতিমার সংগে ছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়।  ১৯৭৯ সাল নাগাদ এই ছবিটির অন্যান্য গানের পাশে এই গানটি সাংঘাতিক হিট হয়েছিল। গানের কথা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরারোপ করেছিলেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়।  কমপ্লিট আর্টিস্ট বলতে যা বোঝায়, প্রতিমা ছিলেন তাই । কি ছায়াছবির গান, রবীন্দ্রসংগীত বা অতুলপ্রসাদের গান সবেতেই তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়া । ছায়াছবির গানের পাশাপাশি তাঁর বেসিক গানের জনপ্রিয়তাও খুব একটা কম নয়। এই লেখার পরবর্তী পর্বে চেষ্টা করব প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেসিক গান ও এই মহাজীবনের শেষ কটা দিনের কিছু অজানা কথা তুলে ধরার।  

(পরবর্তী অংশ প্রকাশিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে)

 লেখায় ব্যবহৃত কয়েকটি গানের ইউটিউব লিংকঃ

 

 ঢুলি ছবিতে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে  এই গানে সমানে পাল্লা দিয়েছিলেন প্রতিমা 

শাপমোচন ছবির সেই বিখ্যাত গান 'ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান'

ক্ষুধিত পাষাণ ছবির সেই গান 

সংসারে যদি নাহি পাই সাড়া তুমি তো আমার রহিবে - অতুলপ্রসাদের এই 

গানে প্রতিমা যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন 


প্রবীর মিত্র

২০/১২/২০২০