Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

সোমবার, ২৮ জুন, ২০২১

তুমি কত যে দূরে ...।



তুমি কত যে দূরে ...।
ঞ্চম বা রাহুল দেব বর্মণের কথা উঠলেই সঙ্গীতপ্রেমী সকল মানুষের কানে রিনরিনিয়ে উঠে এক ঝাঁক কিছু গানের সুর যেগুলো সত্তর আশির দশকে সারা ভারতের যুব সমাজকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল । বাবা শচীন দেব বর্মণের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের মিউজিকের একটা  ঘরানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন । 



 

চলচ্চিত্রে শুধু মাত্র বিভিন্ন ধরনের সুরসৃষ্টই নয় আর ডি-কে একজন সঙ্গীত গবেষক হিসাবেও আমরা পাইগিটারিস্ট নীলাঞ্জন নন্দীর কথায় জানা যায়, ভরাট সুর ছিল পঞ্চমের অতি প্রিয় । শুনতে ভালোবাসতেন   ‘জ্যাজ’ । আর সেই সুত্রে বিখ্যাত ‘জ্যাজ’ শিল্পী লুইস ব্যাঙ্কস কে তিনি আবিস্কার করেন কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে অবস্থিত ‘Trincus’ রেস্তরা থেকে । যারা আশির দশকে আমার মতো রেডিও শুনে বড় হয়েছেন তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন শশী কাপুর অভিনীত ‘মুক্তি’ ছবিতে পঞ্চম অসাধারন একটি সুর কম্পোজ করেছিলেন যেটি পিয়ানোয় প্রান পেয়েছিল লুইস ব্যাঙ্কসের আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ।  ওফ কি দুর্দান্ত সুর সৃষ্টি করেছিলেন পঞ্চম । আসলে ছন্দ আর রিদম ছিল পঞ্চমের রক্তে । একটু মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায় ওর সৃষ্ট সব গান অথবা মিউজিক পিস এ অসাধারন কিছু তালের প্যাটার্ন পাওয়া যায় যেগুলোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পাইওনিয়ার ।    
সুরসৃষ্টির নেশায় পঞ্চম মহ রফির সাথে


লুইস ব্যাঙ্কসের পাশাপাশি আরও একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন আমাদের কলকাতার খুব কাছের ঊষা উত্থুপ (তখন ছিলেন আইয়ার) । সময়টা ৬০ এর দশকের শেষ দিক ।  পঞ্চম গেছেন ‘Trincus’    তখন ঊষা আইয়ার ছিলেন জনপ্রিয় পপ গায়িকা । মূলত ইংরেজি গানই তিনি বেশীর ভাগ গাইতেন ।  ঊষার গানের ধরন পঞ্চমের মনে গেঁথে গেল ।  হয়ত সেই দিনই পঞ্চম মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন তাঁর আগামী ছবি ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণ’ তে ঊষাকে দিয়ে একটা অন্য ধরনের গান গাওয়াবেন । আর হলও তাই, ১৯৭১ এর বিখ্যাত হিট ছবি  ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণ’ তে পঞ্চম সৃষ্টি করলেন একটা অসাধারন গান "I Love You" যেটি গেয়েছিলেন  ঊষা উত্থুপ আর তার সাথে যোগ্য সংগত দিয়েছিলেন আশা ভোঁসলে । 
 

                        ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণ’ তে সেই অসাধারন গান "I Love You"
 
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা অপূর্ব মেল বন্ধন ঘটিয়েছিলেন ‘তিসরি মঞ্ছিল’ থেকে শুরু করে মেরে জীবন সাথী, মেহবুবা, আজনবি, খুশবু, পরিচয়, শোলে, গোলমাল, শান, দ্যা ট্রেন, আপনা দেশ, অর্জুন, কটি পতঙ্গ ইত্যাদি আরও অনেক ছবিতে ।   
 
পঞ্চমের মিউজিক্যাল জার্নিতে যেসব সহকারী মিউজিসিয়ানরা সময় তাঁর পাশে থেকেছেন 
 
পঞ্চমের শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি হয় উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের হাতে। ৭০ এর পঞ্চম শুধু বিদেশি সংগীত নিয়ে পড়ে থাকেননি, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়েও বেশ কিছু কাজকর্ম করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন গুলজার সাহেবের লেখা আর কিশোর কুমারের গলা। আর ডি, গুলজার আর কিশোর কম্বিনেশন বলিউড কাঁপিয়ে দেয় ৭০ এর দশকে। কি সব গান বেরিয়ে এসেছিল এই তিনজনের যুগলবন্দীতে! ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’, ‘ মাঝি রে আপনা কিনারা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোয়ি’, ‘তুম গ্যায়ে হো নুর গ্যায়া হ্যায়’, ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায় তবে কিশোর কুমারের সাথে একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল আর ডি-র। শুধু রাগপ্রধান গান গাওয়া ছাড়াও কিশোরের গলায় রাজেশ খান্নার লিপে আর ডি ভারতবর্ষকে সুরমূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন একটা গোটা দশক। এইসময় বেশকিছু পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে তিনি পিছনে ফেলে দেন তাঁর সমসাময়িক মিউজিক ডিরেক্টরদের। কিছু গানের শুরুতে এমন কিছু আওয়াজ তৈরি করেন যা সেইসময় বসে করা দূরে থাকা ভাবতেও কেউ পারতেন না। কিন্তু তিনি তো সরস্বতীর বরপুত্র। তাই অনায়াসে অমন শব্দ সৃষ্টি করে গেছেন। যেমনশোলেসিনেমায়মেহবুবা মেহবুবাগানের আগে ফাঁকা বোতলের শব্দ, ‘পড়োসনসিনেমায়মেরে সামনেওয়ালি খিড়কিগানের আগে চিরুনি ঘষার শব্দ, ‘ইঁয়াদো কি বারাতসিনেমায়চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কোগানের আগে বোতলের গায়ে কাঁটা চামচ ঠোকার শব্দ, অথবা 'কিতাব' ছবির সেই বিখ্যাত গান 'ধান্নো কি আখো মে রাত কা সুরমা', গানটিতে একটা বিশেষ ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেটের সাউন্ড এফেক্ট  ব্যবহার করেছিলেন যেটা একদমই কোন মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট নয় ।   'ঘর' ছবির সেই গানটা মনে আছে, 'তেরে বিনা জিয়া যায়ে না' যাতে পঞ্চম একসঙ্গে  ব্যবহার করেছিলেন চার চারটে তবলা চার রকম তালে। শুধু মাত্র গানের সুর ছাড়াও ছবির সিকয়েনস মিউজিক বানানোতেও তিনি ছিলেন বেতাজ বাদশা ।  এই প্রসঙ্গে মনে এল ১৯৮৫ এর ছবি ‘অর্জুন’, সানি দেওল অভিনীত একটি ফ্লপ ছবি কিন্তু এর প্রতিটি গান লোকের মুখে মুখে ফিরত । এই ছবির সিকয়েনস মিউজিকে পঞ্চম সৃষ্টি করেছিলেন অসাধারন কিছু ফিউশন ।  যারা দেখেছেন তারা নিশ্চই মনে করতে পারবেন একটি বর্ষণসিক্ত  সন্ধ্যায় বাজারের ভিতর দুষ্কৃতীকারীরা একজনকে তাড়া করে খুন করার এক হাড় হিম করা দৃশ্যের কথা । এখানে পঞ্চম নিজের ভয়েসটিকে খুব সুনিপুন ভাবে ব্যাবহার করেছিলেন তার সাথে ছিল আফ্রিকান ড্রাম যেটি বাজিয়েছিলেন ‘বসানভা’ নামে পঞ্চমের একজন মিউজিশিয়ান । একেবারে অন্যরকম আঙ্গিকে বাজানো । দৃশ্যটি দেখার সময় যদি আপনি ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখেন, তবুও কানে যে আবহটি ঢুকবে, সেটাই জানান দেবে যে পর্দায় কিছু ভয়ংকর একটা ঘটছে   রাহুল দেব বর্মণের সুরের এটাই ছিল একটা বৈশিষ্ট । 

    
অর্জুন ছবির সেই বিখ্যাত মিউজিক যেখানে রাহুল নিজের কণ্ঠ ও আফ্রিকান ড্রাম ব্যবহার করেছিলেন
 
 [ ছবি রায় হলেন রুবি রায়, কি করে ??? জানতে এখানে ক্লিক করুন ]

নিজের গলার স্বর ও শ্বাস প্রশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অসাধারন কিছু গানের সিকয়েনস মিউজিক । যার একটি হল,  ‘মেরা নাম হ্যায় শবনম, প্যার সে লগ মুঝে শাব্বু কায়তে হ্যায়’, কটি পতঙ্গ (১৯৭১)  ছবির এই গানটি যদি কেউ শোনেন তাহলে কান দিয়ে অনুভব করবেন পঞ্চম এখানে আশা ভোঁসলের গানের পাশাপাশি নিজের শ্বাস প্রশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন দুর্ধর্ষ একটি সিকয়েনস   অনেকেই জানে না এটি ভারতের সর্ব প্রথম র‍্যাপ সঙ   (অনেকে অবশ্য বলেন ভারতের প্রথম র‍্যাপ সঙ হল ‘আশীর্বাদ’ ছবির ‘রেলগাড়ি রেলগাড়ি’ গানটি যেটি গেয়েছিলেন দাদামনি অশোক কুমার এবং গানটির সুরকার ছিলেন বসন্ত দেশাই) ।    এই রকম আরও একটি গান পঞ্চম নিজে গেয়েছিলেন 'আপনা দেশ' ছবিতে 'দুনিয়া মে লোগো কো ধোঁকা কাভি হো যাতা হে'। গানটি যারাই শুনেছেন তারাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন একই সাথে নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের সাউণ্ড এফেক্ট কে কাজে লাগিয়ে সমান তালে গানটি তিনি গেয়েছেন, আশা ভোঁসলের যোগ্য সঙ্গতে।


                   নিজের গলার স্বর ও শ্বাস প্রশ্বাসকে দুর্দান্ত ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন এইগানে



এর পাশাপাশি পঞ্চম ছিলেন একজন ভালো যন্ত্রশিল্পীও ।    তবলা, মাউথ অর্গান ও সরোদ বাজাতে পারতেন সমান তালে । গুলজারের ‘দিল পারসি হ্যায়‘ এ্যালবামে সুর সৃষ্টির পাশাপাশি অনেকগুলি গানে তিনি সেতারও বাজিয়েছিলেন   এই এ্যালবামের একটা বৈশিষ্ট ছিল বেশ কিছু সাউন্ড এফেক্টের নিপুন ব্যবহার, যেমন, জলের শব্দ, জাহাজের ভেঁপু, পাখির কিচিরমিচির, বাইকের শব্দ, গির্জার ঘণ্টার শব্দ যেগুলি পঞ্চম খুব পরিশ্রম করে সংগ্রহ করেছিলেন কারণ এই এ্যালবামটা তাঁর জীবনের একটা স্বপ্ন ছিল আর সেই জন্যই বোধহয় সাউন্ড এফেক্টের ব্যাপারে তিনি কোন আপোষ করতে চান নি    
 
 

  দিল পারসি অ্যালবামের একটি গান
 
বন্ধু লক্ষ্মীকান্ত (লক্ষ্মীকান্ত প্যারালাল) এর কথায় জানা যায়, ‘দোস্ত’ ছবিতে পঞ্চম একজন সাধারন মিউজিসিয়ানের মতোই স্টুডিয়োতে এসে রেকর্ড করেছিলেন মাউথ অর্গানের সুর ।  এতে তার মধ্যে কোন ইগো কাজ করেনি । ভীষণ আমায়িক এই মানুষটির দিনের মধ্যে তাঁর মিউজিক রুমেই কেটে যেত দশ বারো ঘণ্টা   নেপালি ফোক ছিল তাঁর খুব পছন্দের ।  এর সুত্রে তিনি পেয়েছিলেন রঞ্জিত গজমের কে যাকে সঙ্গীত জগত চেনে কাঞ্চা নামে ।  ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণা’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘কাঞ্চী রে কাঞ্চীরে’ , কিশোর কুমারের গলায় সেই বিখ্যাত গানটা কখন পুরনো হবে না যার সুর পঞ্চম বানিয়েছিলেন একটি নেপালি ফোকের উপর । এই গানের নেপালি থুম্বা বাজিয়েছিলেন রঞ্জিত গজমের ।  ‘হাম দোনো দো প্রেমী দুনিয়া ছোড় চলে’ , আজনবি ছবির এই গান ও ‘হো গা তুম সে প্যারা কউন’ , জামানে কো দিখানা হ্যায় ছবির গান গুলিতেও ছিল  নেপালি থুম্বা ও একটা সুন্দর নেপালি ফ্লুট এর সুর যা আজও খুব জনপ্রিয় । 
 
পঞ্চম নিজে থেকে গান গাইতে চাইতেন না।  যদি কোন গায়ক নিজে থেকে অপারগতা জানাতেন, তবেই তিনি সেই ছবিতে গান গাইতেন, কারণ পঞ্চমের কিছু কিছু সুরে যে আপ-ডাউন থাক্তন, সেই অনেকের পক্ষেই তোলা সব সময় সম্ভব হত না। 'জমানো কো দিখানা হ্যায়' ছবির একটি গান 'দিল লেনা খেল হ্যায় দিলদার কা' তেমনই একটা গান। 'শোলে'র 'মেহবুবা মেহবুবা' সেই তালিকায় পড়ে, শোনা যায় প্রথমে তিনি এই গানটা কিশোরকুমারের জন্য ভেবেছিলেন তারপর মান্না দে, কিন্তু তারা কেউ রাজী না হওয়ায় গানটি পঞ্চম নিজের মতো করে বেঁধেছিলেন।  তারপর তো এই গান ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। 

‘প্যান্থেরা’ এলবামের রেকর্ড কভার
আশির দশকের মাঝামাঝি আমেরিকায় নিগ্রো সঙ্গীত ব্যাক্তিদের সাথে ও বয় জর্জের সাথে হাত মিলিয়ে  করেছিলেন বানিয়েছিলেন এক নতুন ধরনেরে সঙ্গীত যার নাম দিলেন ‘প্যান্থেরা’ ।  লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার প্রানমাতান সুরের কাঠামোকে মাথায় রেখে কম্পোজ করলেন পুরো এ্যালবামটি ।




একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া দিয়ে শেষ করছি।  জানেন, বাবা শচীন দেব বর্মণ মাত্র একবারই ছেলে রাহুলের সুরে একটি মাত্র গান গেয়েছিলেন।  
বাবা ও ছেলে এক ফ্রেমে

নিজে একজন খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালক সেইজন্যই হয়তো একটা ইগো কাজ করত ছেলের ছবিতে গান না গাইবার।   ১৯৭২ সালে শক্তি সামন্ত পরিচালিত 'অমর প্রেম' ছবিতে শেষ পর্যন্ত শচীনকর্তার ইগো পরাজিত হোল, ছেলে পঞ্চমের অনুরোধ আর ঠেলতে পারলেন না।  ছবিতে ছেলের সুরে গাইলেন সেই কালজয়ী গান, 'ডোলি মে বিঠাই কে কাহা'।   আর এই 'অমর প্রেম' ছবিটি ছিল ১৯৭০ সালে রিলিজ হওয়া পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি ছবি 'নিশিপদ্ম'-এর হিন্দি রিমেক, যাতে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।   বনফুলের একটি ছোট গল্প 'হিঙের কচুরি' এর চিত্ররূপ হোল এই নিশিপদ্ম ও হিন্দিতে অমর প্রেম।  
 
 
 অমর প্রেম সিনেমাতে পঞ্চমের কম্পোজ করা শচীন দেব বর্মণের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান 
 
 এই সামান্য পরিসরে,  রাহুল দেব বর্মণের মতো ব্যাক্তিত্বকে তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন । তাই আজ ওনার ৮২ তম জন্মদিনে সুবিশাল সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল তোলার মতো কিছু দিক শেয়ার করলাম ।  আপনাদের ভালো লাগলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে ।  তবে কথা দিচ্ছি রাহুল দেব বর্মনের সুরসৃষ্টি নিয়ে আরও কিছু লেখার ইচ্ছে রইল ভবিষ্যৎ-এ।   

  [ ছবি রায় হলেন রুবি রায়, কি করে ??? জানতে এখানে ক্লিক করুন ]


তথ্যঋণ ঃ   সাপ্তাহিক বর্তমান , আনন্দলোক, মুঝে চলতে জানা হ্যায় - a musical documentary on Rahul Dev Burman by Brahmanand S Singh, 

প্রবীর মিত্র
২৭/০৬/২০২১

                        












সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

চেনা গানের অজানা কথা ৮

 

 চেনা গানের অজানা কথা

সলিল চৌধুরী তাঁর প্রিয় তিন শিষ্যকে বেশ সুন্দর একটা নাম দিয়েছিলেন। ‘প্রবীরানলাভিজিত’। অর্থাৎ  প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায় ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ।  তিন জনেই বাংলাগানের বিখ্যাত সুরকার। এঁদের মধ্যে অভিজিৎবাবু আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে একজন শ্রদ্ধেয় ও স্মরণীয় ব্যাক্তিত্ব। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক।  উনি আমার প্রিয় সঙ্গীত ব্যাক্তিত্বদের মধ্যে একজন।  একসময় প্রচুর শ্রুতিমধুর আধুনিক ও ছায়াছবির বাংলা গান আমরা উপহার পেয়েছি ওনার কাছ থেকে ।  ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতার সুরারোপ এবং তারপর সলিল চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে অভিজিৎবাবুর সাংগীতিক যাত্রাপথের শুভারম্ভ।   শ্যামল মিত্রের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি ছিল ‘ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা দেয় দুরপাল্লা’, যা আরও সমান জনপ্রিয়।   আজ এই এপিসোডে সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরসৃষ্ট দুটি গানের রেকডিং-এর  নেপথ্য কাহিনী আপনাদের সাথে শেয়ার করব।   আজ আবার বিশ্বসংগীত দিবস।  সংগীতের সাথে যুক্ত সমস্ত কলাকুশলীদের এবং এই ব্লগের সমস্ত পাঠক পাঠিকাদের জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকবেন, ভালো গান শুনবেন ও অন্যদের শোনাবেন।

১৯৬৬ সালের ছবি ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’-তে অভিজিৎবাবুর প্রথম বাংলা ছায়াছবিতে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ এরপর ১৯৭২ সালে ‘ছায়াতীর’ ছবিতে সুরারোপ। ছবিদুটিতে ওনার সুরে গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন ও

সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

গীতা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী। ১৯৭৪ সালে পরিচালক সলিল রায় ‘জীবন রহস্য’ নামক একটি থ্রিলার ছবির কাজ শুরু করলেন।  বোম্বাই-এর ‘প্রাণ’ ছিলেন এই ছবির প্রান অর্থাৎ প্রধান চরিত্র।  বালাই বাহুল্য এটিই ‘প্রাণ’ অভিনীত প্রথম বাংলা ছবি।  ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার গুরুদ্বায়িত্ব পেলেন অভিজিৎবাবু। ছবিতে সর্বমোট চারটি গান। দুটি গান মান্না দে গাইবেন আর বাদবাকি দুটি গাইবেন আশা ভোঁসলে।  মান্নাবাবুর গান ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখ, আমরা দুজনে কত সুখী’ এবং ‘কে তুমি শুধুই ডাক’ গানদুটি নির্বিঘ্নে রেকর্ডিং হয়ে গেল। মুস্কিল হোল আশাজির গানের রেকর্ডিং –এর সময়।  আশাজী তখন বোম্বাই-এর প্রচণ্ড ব্যাস্ত একজন শিল্পী।  সেই সময়কার প্রায় সবকটি হিন্দি ছবিতেই ওনার গান, এক একদিন প্রায় ৮/১০ টা রেকর্ডিং-এর কাজে উনি ব্যাস্ত থাকেন।  এদিকে আবার একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটেছিল। কোলকাতার এক সঙ্গীত পরিচালকের আশাজীকে দেওয়া একটি চেক বাউন্স করে, তাই আশাজী একটু বিরক্তও ছিলেন মনে মনে কোলকাতার সঙ্গীত পরিচালকদের উপর। কোলকাতার সুরকারদের উপর আর বেশী ভরসা করতে পারছিলেন না।   অবশেষে মান্না দে-র হস্তক্ষেপে আশাজীর কাছ থেকে জুন মাসের ৩ তারিখে একটা ডেট পাওয়া গেল।   
সিনেমার পোস্টার

 

সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আগের মাসের শেষের দিকে একটু অ্যাডভান্সই বোম্বাই চলে গেলেন।  রেকর্ডিং যেহেতু ৩ তারিখ তাই ব্যাস্ত আশাজীকে আগে সময় করে গানদুটিকে তোলাবেন।  কিন্তু কয়েকদিন পরেই তিনি জানলেন উক্তদিনে আশাজী অভিজিৎবাবুর গান রেকর্ডিং করবেন না, অন্য কয়েকজন খ্যাতনামা সুরকারদের উনি সেইদিন সময় দিয়েছেন।  সুতরাং আবার ডেট ফিক্সড হোল ১৩ তারিখে, তাও দুটো নয় মাত্র একটা গান গাইবেন তিনি। একটু মুষড়ে পরলেন অভিজিৎবাবু।  ভাবলেন আর একটি গান কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়।  কিন্তু কয়েকদিন যেতেই তিনি জানতে পারলেন ১৩ তারিখে আশাজী আরও সাতজন মিউজিক ডাইরেক্টরকে ডেট দিয়ে ফেলেছেন গান রেকর্ডিং-এ তার মধ্যে তাঁর স্বামী রাহুল দেব বর্মণও আছেন।  হতাশ অভিজিৎবাবু যোগাযোগ করলেন মান্না দে-র সাথে, যিনি আশাজীর রেকর্ডিং-এর ডেটের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন।  সবশুনে মান্নাবাবু আশ্বাস দিলেন অভিজিৎবাবুকে। ৯ তারিখ আশাজীর সাথে মান্না দে-র একটি হিন্দি ছবির গানের রেকর্ডিং আছে,

মান্না দে

সেদিন উনি সময়মতো অভিজিৎবাবুর গানের রেকর্ডিং-এর ব্যাপারে কথা বলবেন তাঁর সাথে। তিনি নিজে বাঙ্গালী তাই মান্নাবাবু এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না।  ৯ তারিখ রাতে অভিজিৎবাবুর হোটেলরুমে একটা ফোন এল। দূরভাষের ওপারে মান্না দে।  ‘১৩ তারিখই রেকর্ডিং হবে, আপনি ঠিক আগের দিন সকাল দশটার আগে আশাজী-র বাড়ী ‘প্রভুকুঞ্জে’ চলে যাবেন এবং ওনাকে আপনার গানটি তুলিয়ে দেবেন’।

১২ তারিখ সকালে সময়মতো অভিজিৎবাবু ‘প্রভুকুঞ্জে’ পৌঁছালেন এবং ‘ও পাখী উড়ে আয়’ গানটি আশাজী-কে তুলিয়ে দিলেন। শ্যামকল্যান রাগের একটি খেয়ালের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই গান শিখে খুব খুশী হলেন আশাজী।   অভিজিৎবাবুকে অনুরোধ করলেন অপর গানটিও শিখিয়ে দেবার জন্য। অন্য কোনদিন তিনি এই অপর

আশা ভোঁসলে

গানটি রেকর্ড করবেন।   তখন অভিজিৎবাবু আশাজীকে ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’ গানটিও তুলে দিলেন।  এটাও খুব ভালো লাগলো তাঁর।  তৎক্ষণাৎ সেক্রেটারীকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘কাল সবার প্রথম আমি কোলকাতার এই ভদ্রলোকের গান রেকর্ড করব, তারপর পঞ্চম (রাহুল দেব বর্মণ) ও অন্যান্যদের গান’, সবাইকে ফোন করে বলে দাও’।

পরের দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ অভিজিৎবাবু খুব টেনশন নিয়ে স্টুডিয়োতে এলেন কারণ এটাই তাঁর সুরারোপিত প্রথম বোম্বাই-এর আর্টিস্ট নিয়ে গান রেকর্ডিং।  এরপর মান্না দে-ও এসে হাজির হলেন অন্য একটি ছবির গানের রেকর্ডিং-এর সূত্রে । এবার অভিজিৎবাবু মনে একটু জোর পেলেন। নির্দিষ্ট সময়ে আশা ভোঁসলে স্টুডিয়োতে এসেই প্রথম রেকর্ড করলেন ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’। খুব ভালোভাবে রেকর্ডিং হোল। অভিজিৎবাবু তখন আশাজীকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন পরবর্তী গানের রেকর্ডিং-এর ডেটটা কবে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে।    অভিজিৎবাবু ও মান্না দে-কে চমকে দিয়ে আশাজী বললেন, “অভিজিৎবাবু, আপনার প্রথম গানটি গেয়ে আমার মুড এসে গেছে, সেটা আর নষ্ট করতে চাই না। আপনি কি এক ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু মিউজিক আরেঞ্জ করতে পারবেন?’ হাতে স্বর্গ পেলেন অভিজিৎবাবু।  সাধারণত একটা গানের রেকর্ডিং-এর পর সঙ্গীতায়োজনের সময়টুকুতে উনি রেকর্ডিং ফ্লোরে থাকেন না।  কিন্তু সেদিন এর ব্যাতিক্রম হোল। মান্না দে পাশেই ছিলেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে, অভিজিৎবাবু, আপনি আর দেরি করবেন না এরপরই পঞ্চমের গানের রেকর্ডিং আছে, আপনি কাজে লেগে যান, ততক্ষন আমি আশাজীর সাথে একটু আড্ডা মেরে নিই”।

একঘণ্টার মধ্যে আবার রেকর্ডিং ফ্লোর রেডি করে নিলেন অভিজিৎবাবু এবং আশাজী রেকর্ড করলেন সেই ‘জীবনরহস্য’ ছবির সেই কালজয়ী গান ‘ও পাখী উড়ে আয়’। ছবিতে প্রত্যেকটি গান হিট করেছিল। আজও এফ এম রেডিও চ্যানেলে এই ছবির গানগুলো শ্রোতাদের কাছে খুব জনপ্রিয়।  

তথ্যঋণ ঃ আজকাল শারদ সংখ্যা ও সা রে গা পত্রিকা  

Probir Mitra

Monday, June 21, 2021

               

 ও পাখী উড়ে আয়

                

 যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া