Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০

ছোটদের গানে সলিল চৌধুরী

 

ছোটদের গানে সলিল চৌধুরী


লিল চৌধুরীর গান প্রথম শোনার কানেখড়ি (এটা সম্পূর্ণ আমার বানানো শব্দ, কোন অভিধানে খুঁজতে যাবেন না যেন), তাঁরই মেয়ে অন্তরা চৌধুরীর মাধ্যমে। কতই বা বয়েস হবে তখন আমার, সদ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছি।  আধো আধো গলার একটা মিষ্টি বাচ্ছা মেয়ের কি সুন্দর সুন্দর সব গান রেডিওতে বাজত।   ‘ও, আয় রে ছুটে আয়, পূজোর গন্ধ এসেছে, ড্যাম কুরাকুর ড্যাম কুরাকুর বাদ্যি বেজেছে’, গাছে শিউলি ফুটেছে, গাছে ভোমরা জুটেছে’।  তখন আমার মতো ডানপিঠে ছেলেরাও চুপ করে শুনত রেডিও থেকে ভেসে আসা সেইসব গানের মেঠ সুর। তারপর গানের শেষে ঘোষকের জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা, “গানটি শুনলেন অন্তরা চৌধুরীর কণ্ঠে, কথা ও সুর সলিল চৌধুরী” ।   তখন ভাবতাম এই সলিল চৌধুরী নামে লোকটা খালি বাচ্ছাদের গান তৈরি করে আর তাদের দিয়ে গাওয়ায়। এই ভাবে শুনেছিলাম আরও একটি মন কাড়া গান, ‘ও মাগো মা, অন্য কিছু গল্প বল, এক যে ছিল রাজা-রানি অনেক হল, বলো না কেন ওই ও পাড়ার দাশুর ছেলে, জ্বরেতে ভুগে, না খেতে পেয়ে মারা গেল’,  অমন মিঠে, মন তোলপাড় করা একটা সুর; অথচ শব্দগুলোর মধ্যে সেই বাচ্ছা মেয়েটার করা প্রশ্নগুলো স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না একতিলও । একটা গান যে গান ছাড়াও অন্য কিছুর জন্ম দেয়, বয়েসটা কাঁচা হলেও সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি সেদিন । গানের মধ্যে এক শিশুমন বড়দের প্রশ্ন করেছিল, এই যে এত সব বাড়ীগাড়ী তাহলে কেন লোকে ফুটপাতে শোয় ? কেন সেদিন অঞ্জনাকে স্কুল থেকে মাইনে দিতে পারেনি বলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ? এই সব একরাশ প্রশ্ন নিয়ে একটা বাচ্ছা মেয়ে গাইছে । এই বুঝি ছোটদের গান !!

অন্তরা চৌধুরির গানের ক্যাসেটের কভার

যেটা বানিয়েছেন একটা বড় মানুষ, সলিল চৌধুরী !  আমিও যখন গানের বাচ্ছা মেয়েটির মতো এইসব প্রশ্ন করতাম তখন বাবা গানের কথায় ঠিক যেমনটি ছিল ঠিক তেমনভাবে বলেছিল আগে তুই বড় হ তারপর নিজেই জেনে যাবি এই গানের প্রশ্নের উত্তরগুলো ।   অনেক পরে অবশ্য জেনেছিলাম, ১৯৮০ সালে ‘রুম নম্বর ২০৩’ ছবির জন্য সলিলবাবু এই সুরসৃষ্টি করেছিলেন, গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে, যোগেশের কথায় ।   পরে এটি সলিলবাবুর কলমে হয়ে যায় একটি শিশুসংগীতে।

 

মেয়ে অন্তরা, স্ত্রী সবিতার সাথে একটি অনুষ্ঠানে সলিল চৌধুরী
শুধু কি তাই, ‘বুলবুল পাখী, ময়না টিয়ে, আয় না যা না গান শুনিয়ে’, এই গানের সাথে যুক্ত হয়ে ছিল এই সব পাখীগুলোর সাউন্ড এফেক্ট ।  আর এটাই ছিল সলিলবাবুর বৈশিষ্ট । মনে পড়েছে সেই ‘ও সোনা ব্যাঙ ও কোলা ব্যাঙ’ গানটির কথা, যেখানে গানের শুরুই হয় গ্যাঙের গ্যাং ব্যাঙের ডাক দিয়ে আর একটা বাচ্ছা মেয়ে দুটো ব্যাঙকে গান
শেখাচ্ছে । গানটা যারা শুনেছেন তাঁরা মনে করতে পারবেন সলিল চৌধুরী কি অসাধারন ব্যাঙেদের সাউন্ড এফেক্ট ব্যবহার করেছিলেন, আর শিশু অন্তরা চৌধুরীর অসাধারন গায়কী ভঙ্গিমা অন্য শিশুদেরও খুব আনন্দ দিত ।  পরে একটা ইন্টারভিউতে শুনেছিলাম, বাবার সুরে মাত্র ৭ বছর বয়েসে অন্তরা ‘মিনু’(১৯৭৭) ছবিতে প্লেব্যাক করেন মান্না দে-র সাথে আর এর জন্য বাবা সলিল, মেয়ের অডিশন নিয়েছিলেন। গানের রেকর্ডিং -এ ছোট্ট অন্তরার পারফর্মেন্স শুনে মান্না দে-র মতো পোড় খাওয়া শিল্পীও খুব অবাক হয়েছিলেন । গানটি ছিল, “তেরে গালিওমে হাম আয়ে”,  মান্না দে-র সাথে অন্তরার এই ক্লাসিক্যাল ঢঙের গান আজও এই মধ্যবয়সে এসে আমার মন ছুঁয়ে যায় !  এই ছবিতে অন্তরার একটি সোলো গানও ছিল, “ও কালি রে কালি রে, তুহ তো কালি রে” ।   এছাড়াও সলিলবাবু আরও বেশ কয়েকটি ছোটদের গান তৈরি করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজ স্ত্রী সবিতা চৌধুরীকে অন্তরার সাথে গাইয়ে নিয়েছেন ।    অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত কবিতা “তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ কর, তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ কর তার বেলা”? এরও সার্থক সুরসৃষ্টি করেছিলেন সলিলবাবু ।   সলিল চৌধুরীর মিউজিকে একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।    কোন গানের প্রিলিউড মিউজিক বাজলেই কান বুঝে নিত এই গানটি সলিল চৌধুরীর অপরূপ সুরসৃষ্টি ।  গানের মধ্যে বিভিন্ন রকম সাউন্ড এফেক্ট এর কাজ ছিল অসাধারন ।  ‘এক যে ছিল মাছি, তার নামটি ছিল পাঁচি’, এই গানটার কথা ভাবুন, একটা মাছি উড়ার কি দুর্দান্ত সাউন্ড এফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ডিজিটালহীন যুগে ।   এছাড়াও আরও বেশ কিছু সলিলসৃষ্ট শিশু সংগীতও আমরা পেয়েছি যেমন সবিতা চৌধুরীর সঙ্গে অন্তরার ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ’ (পরবেশ ছবিতে),  ‘খুকুমনি গো সোনা বল না বল না’ ইত্যাদি সব অসাধারন গান।    
মা সবিতা চৌধুরীর সাথে অন্তরা 

আসলে গান নিয়ে সলিল চৌধুরীর এক্সপেরিমেন্ট সংক্রান্ত লেখাটা আমার মতো একজন সামান্য ব্লগারের কাছে খুব দুঃসাহসের কাজ ।  কিন্তু সলিলবাবুই যে আমাদের শিখিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের গান বা মিউজিক শোনার অভ্যেস করতে, যাতেই অনেক কিছু শেখা হয়ে যায় ।

সলিল চৌধুরীর মতো ব্যাক্তি এ দেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকদের মধ্যে একজন । গানের কথা, সুর, চলচ্চিত্রের নেপথ্য সংগীত, সবেতেই তিনি এমন দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, যা যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকবে বলে প্রত্যেক সংগীতপ্রেমীর বিশ্বাস । গতকাল আমরা তাঁর ৯৫-তম জন্মদিন পেরিয়ে এলাম ।   তিনি সর্বহারার নন, সর্বজনের শিল্পী। এক হাজার মায়া আর দুশ ভালোবাসা বুকপকেটে নিয়ে তাই তিনি আজও আমাদের আনন্দগাড়ীর সহযাত্রী । 

 

 

                                 ১৯৮০ সালে রিলিজ হওয়া ‘রুম নম্বর ২০৩’ সেই বিখ্যাত গান 

 

        ‘মিনু’(১৯৭৭) ছবিতে এই গানের মাধ্যমে অন্তরার প্লেব্যাক শুরু মান্ন দে-র সাথে

 

আজ এই ব্লগপোস্টে সলিল চৌধুরীর তৈরি কিছু শিশুসংগীতের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম, ইচ্ছে রইল এই মহান সুরস্রস্টাকে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কিছু লেখার ।   

 প্রবীর মিত্র

২০/১১/২০২০


 

৪টি মন্তব্য:

Rakesh K. Das বলেছেন...

খুব ভাল লাগল। সলিল চৌধুরিকে নিয়ে যত বলা হোক না কেন কম কম বলা হয়। ও মাগো মা'র হিন্দি ভার্সানটা শুনে খুব ভাল লাগল। সলিলবাবুর নানা ধরণের গান বা গান তৈরি হওয়ার পেছনের গল্প যদি শোনাও খুব ভাল হয়।

Probir's Feel Notes বলেছেন...

চেষ্টা করব রে।

@অনুভব বলেছেন...

অসাধারণ। পড়তে পড়তে দেখতে পাচ্ছিলাম।

Probir's Feel Notes বলেছেন...

@অনুভব ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।