Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯

হেমন্ত কালের ১০০ বছর ...দ্বিতীয় পর্ব


।।হেমন্তকালের ১০০ বছর ।।
 
প্রবীর মিত্র
 
[ নামে হেমন্ত হলেও কণ্ঠে তিনি চিরবসন্ত  গত ১৬ই জুন তিনি শতবর্ষে পদার্পণ করেছেন মৃত্যুর ৩০ বছর পর আজও হেমন্ত কণ্ঠের অজস্র মন পাগল করা বাংলা ও হিন্দি গানের সুর আকাশে রামধনুর মতো সাতরঙ ছড়ায় । এই লেখায় ব্যবহৃত বেশ কিছু জনপ্রিয় গানগুলির ইউটিউব লিংক দিলাম  অবশ্যই লিংক-এ ক্লিক করে শুনবেন হেমন্তকণ্ঠের জাদু ।  আজ শেষ পর্ব  কেমন লাগলো জানালে খুব আনন্দ পাব যদি প্রথম পর্ব না পড়ে থাকেন তাহলে পড়তে ক্লিক করুন এখানে ।] 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়




১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হারানো সুর’ ছবির পরিচালক ছিলেন অজয় কর  ছবির নায়িকা হলেন সুচিত্রা সেন । সেইসময় সুচিত্রা সেন ছবির হিরোইন হলেই গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হিরোইনের লিপে সবকটা গান গাইতেন । আর সেইসব ছবিগুলি হিটও হত।  তা হয়েছে কি ছবিতে একটি গান ছিল ‘তুমি যে আমার, বল তুমি যে আমার’ । গানের সুর হয়ে যাবার পর হেমন্ত দাবি করে বসলেন এই গানটি প্লেব্যাক করবে গীতা দত্ত ।  ছবির পরিচালক, গীতিকার থেকে নায়ক সবাই শুনে একেবারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন । হেমন্ত বলেন কি, সুচিত্রার লিপের জন্য অন্য গায়িকা !! অসম্ভব এটা হতেই পারে না । আগের ছবির মতোই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই এই গানটি গাইবেন । হেমন্ত এবার খুব বিরক্ত হয়ে বললেন , ‘বেশ তবে আমাকে ছেড়ে দিন, অন্য কোন সংগীত পরিচালক এই ছবির মিউজিকের দায়িত্ব নিক । অবশেষে হেমন্তর জেদের কাছে সবাই পরাজিত হলেন । গীতা দত্ত সেই প্রথমবার সুচিত্রার জন্য প্লেব্যাক করলেন ।  রেকর্ডিং হয়ে যাবার পর হেমন্ত সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, “চিন্তা করবেন না গানটা হিট করবেই’ এবং হেমন্তর কথা একেবারে ফলে গিয়েছিল । আজও রেডিওতে এই গানটি খুবই জনপ্রিয় । 

সুরকার নচিকেতা ঘোষ উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির গান রেকর্ডিং করতে বোম্বাই এসেছেন । হেমন্ত ও গীতা দত্ত দুজনেই যখন বম্বেতে তাই দুজনকে একসাথে কলকাতা আনার থেকে নচিকেতাবাবু নিজেই বোম্বাই চলে এসেছেন ।  গিয়ে উঠলেন গীতাঞ্জলীতে, হেমন্তবাবুর বাড়ি ।   নচিবাবু  চাইছিলেন ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে হেমন্ত এবং গীতার গানের পাশাপাশি একটা হিন্দি গানও থাকবে এবং সেটি গাইবেন মহঃ রফি সাহেব ।  ভাবামাত্র ফোন করে বসলেন ছবির প্রযোজককে । প্রযোজক তো নচিবাবুর ইচ্ছের কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন । তার কারন মহঃ রফির ফিজ তখন খুব বেশী । একটি গান গাইবার জন্য তিনি প্রচুর টাকা পারিশ্রমিক নেন ।   নচিবাবু বললেন একবার চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই আমি যখন বোম্বাইতে আছি   প্রযোজক শেষে রাজি হলেন কিন্তু এই গানের জন্য তিনি ৫০০ টাকার বেশী তিনি খরচ করতে পারবেন না এটাও পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিলেন । 

তারপর একদিন হেমন্তকে নিয়ে সুরকার নচিকেতা ঘোষ হাজির হলেন মহঃ রফির বাড়িতে । মহঃ রফির সঙ্গে হেমন্তর একটা খুব সুন্দর একটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল ।   মহঃ রফির সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবার পর নচিকেতা ঘোষ শোনালেন সেই গানটি যেটি উনি মহঃ রফির কণ্ঠে রেকর্ড করাতে চান । সুর শুনে রফি খুব উচ্ছ্বাসিত ।  ‘বাহ, ক্যায়া মিঠা সুর দিয়া আপনে’ ।    নচিকেতা তখন মরিয়া হয়ে হাতজোড় করে বললেন, গানটা আপনাকে গাইতেই হবে রফি সাহেব আর এর জন্য আমি আপনাকে ৫০০/- টাকার বেশী পারিশ্রমিক দিতে পারব না ।   নচিকেতার কথা শুনে রফি সাহেব একটু হোঁচট খেলেন, ৫০০/- টাকায় মহঃ রফির গান ।   এতো অবিশ্বাস্য । তারপর হেসে বললেন, ‘আপকা সুর বহুত মিঠা আউর আপ মেরা হেমন্তদাদা কো সাথ আয়ে হ্যয়’, ম্যায় আপকা সুর কিয়া গান জরুর গাউঙ্গা’ । আসলে সেইসময় শিল্পীদের মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্বাভক্তি ও সন্মান ছিল ।  যেটা হয়তো এই সময় খুবই অভাব । ওই ৫০০ টাকাতেই সৃষ্টি হল ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে মহঃ রফির গাওয়া একটি যুগান্তকারী গান ‘সব কুছ লুটা কর’ (https://www.youtube.com/watch?v=OShV-XNqd3I)   এর পাশাপাশি ওই ছবির ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়’ গানটি হেমন্ত ও গীতা দত্তর ডুয়েট এবং ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো’ গানটি হেমন্তর একক গান যা সুপার হিট হয়েছিল সেই সময় ।     
      

আর একটি ঘটনার কথা বলি,  ভূপেন হাজারিকা একদিন বম্বে গেছেন এবং উঠেছেন হেমন্তর বাড়ি, গীতাঞ্জলীতে । ভূপেন খুব ভালো গল্প বলতে পারতেন । রবিবাসরীয় সান্ধ্য আড্ডাটা ভূপেন হাজারিকার গানে ও গল্পে জমে উঠত ।  এইরকম একদিন সান্ধ্য আড্ডায় তাঁর পড়া একটা গল্প বললেন হেমন্ত ও বেলাকে । গল্পটির লেখিকা হলেন মহাদেবী বর্মা গল্পটি খুব পছন্দ হল হেমন্তর এবং সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে ফেললেন গল্পটি নিয়ে তিনি একটি ছবি প্রযোজনা করবেন এবং মূল চরিত্রে থাকবেন উত্তমকুমার ।  এরপর কলকাতায় এসে যোগাযোগ হল নবীন  পরিচালক মৃণাল সেন এর সাথে । হেমন্ত মৃণালকে ছবির গল্পটা শোনালেন এবং ছবিটা পরিচালনার জন্য প্রস্তাব দিলেন ।  কিন্তু সমস্যা তৈরি হল উত্তমকুমারের দিক থেকে । নবীন পরিচালক মৃণালকে তিনি শুটিং এর ডেট দিলেও মেকআপ-এর সময় একটা সমস্যা দেখা দিল । উত্তমকুমারকে চৈনিক রূপ দিতে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগছে । কিন্তু পেশাদার উত্তমকুমার অতখানি সময় মেকআপ-এ দিতে রাজি হলেন না । এদিকে যথাযথ চৈনিকরূপ দিতে না পারলে ছবির নায়কের কোন মূল্যই থাকবে না ।    তাই হেমন্ত ও মৃণাল উত্তমকুমারকে বাধ্য হয়ে ছবি থেকে বাদ দিলেন এবং সেই জায়গায় নিয়ে এলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে এতে অবশ্য উত্তমকুমার কিছু মনে করেন নি কারন তিনি অবস্থাটা উপলব্ধি করেছিলেন ।     যারা ১৯৫৯ সালে রিলিজ হওয়া ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি দেখেছেন তাঁরাই অনুভব করেছেন উত্তমকুমারের থেকে কোন অংশে কম নয় কালীবাবুর অভিনয় । আর এর পাশাপাশি মঞ্জু দে ও বিকাশ রায়ের অভিনয় তো আছেই । এই ‘নীল আকাশের নীচে’  ছবির সূত্র ধরেই সূত্রপাত হয়েছিল হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন হাউসের   ছবিতে হেমন্ত সৃষ্টি করেছিলেন দুর্ধর্ষ দুটি গান ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’ এবং ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ তুমি দেখছ কি’   শুধু তাই নয় ছবিতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছিল চাইনিজ ম্যাণ্ডোলিন-এর অপূর্ব সুর ।   ছবির বিশেষ শো দেখতে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু, রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, উপরাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ । ছবি দেখে তারা মোহিত ।  হেমন্ত ও মৃণালকে জহরলাল সেদিন বলেছিলেন “you have done a great job to our nation”  প্রযোজক হিসেবে হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন হাউস বেশ ভালোই খ্যাতি পেল এবং মৃণাল পেলেন প্রভূত খ্যাতি ও সন্মান ।
নীল আকাশের নীচে ছবির পোস্টার   
 কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে মৃণাল সেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার সন্মানে ভূষিত ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটিকে তাঁর ফিল্মি কেরিয়ারের সূচনা হিসাবে স্বীকৃতি দেন নি ।  তার জায়গায় স্থান পেয়েছিল ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিটি । 
       
এই প্রসঙ্গে একটু জানিয়ে রাখি, ‘নীল আকাশের নীচে’  ছবিতে ব্যবহৃত ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’ গানটি এতটাই  জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে হলিউডের পরিচালক কনরাড রুকস তাঁর ‘সিদ্ধার্থ’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেছিলেন ।  শশী কাপুর ও সিমি গারওয়াল অভিনীত এই ছবিতে পরিচালক হেমন্তর গাওয়া আরও একটি গান ব্যবহার করেছিলেন যেটি হেমন্ত গেয়েছিলেন ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে । গানটি ছিল ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কুলে তব মা গো বল কবে শীতল হব কত দূর আর কত দূর বল মা’ ।  
 
এরপর থেকে কলকাতায় হেমন্ত প্রায় সব ছবিতেই প্লে ব্যাক করছেন । উত্তমকুমারের লিপে তাঁকে ছাড়া কাউকেই ভাবতে পারছেন না সংগীত পরিচালকরা তার সাথে আবার অন্য ছবির প্লে ব্যাক ও আছে । এরপর থেকে হিন্দি ছবির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসতে থাকে কারন বাংলার প্রতি হেমন্তর টান খুবই জোরাল ।  একটা সময় এল হাতে কোন হিন্দি ছবির কাজ নেই । তখন তিনি স্থির করলেন বোম্বের মাটিতে তিনি হিন্দি ছবির প্রযোজনা করবেন । তাঁর প্রযোজনায় ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি বেশ ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে । এবার হেমন্ত স্যার আরথার কোনান ডয়েলের কাহিনী ‘The hound of Buskervills’ এর ছায়া অবলম্বনে প্রযোজনা করলেন ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিটি । নায়ক নবাগত বিশ্বজিত ও নায়িকা ওয়াহিদা রাহমান ।  ছবির গান ও শুটিং যখন ফাইনাল তখন গুরু দত্ত এলেন হেমন্তর কাছে তাঁর ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে সুরারোপ করানোর জন্য ।  হেমন্ত তখন খুব ব্যস্ত তাঁর ড্রিম প্রোজেক্ট ‘বিশ সাল বাদ’ এর জন্য । গুরু দত্ত কে ফেরালেন না হেমন্ত । দুটো ছবির কাজই একসঙ্গে শুরু করলেন । 

‘বিশ সাল বাদ’ রিলিজ করল ১৯৬০ এ এবং দারুন হিট করল । হেমন্তর গান ও মিউজিক দুটোই সুপার হিট ।  ‘বেকারার করকে হামে’ (https://www.youtube.com/watch?v=xpIJQri622A ) ও লতার গাওয়া ‘কোই দীপ জ্বলে কোই দিল’ (https://www.youtube.com/watch?v=c1tXbULiwx8 ) ছবির এইদুটো গান আজও বিভিন্ন রেডিও তে বাজে ।  

এরপর তিনি হাত দিলেন ‘শরমিলি’ ছবির প্রযোজনাতে । নায়ক হিসাবে ভাবা হল উত্তমকুমারকে ।  নায়িকা সেই ওয়াহিদা রাহমান ।  কিন্তু শুটিং এর দিন উত্তমকুমার জানিয়ে দিলেন তিনি আসতে পারবেন না । ভীষণ আঘাত পেলেন হেমন্ত । অনেক অর্থের ক্ষতি । ছবির কাজ থেকে পিছিয়ে এলেন হেমন্ত ।  কিছুদিন পর আবার বিশ্বজিত ও নায়িকা ওয়াহিদা রাহমান কে সঙ্গে নিয়ে হেমন্ত শুরু করলেন ‘কোহরা’ ছবির কাজ । স্যার আলফ্রেড হিচককের ‘রেবেকা’ ছবির ছায়া অবলম্বনে এই ছবির পিছনে হেমন্ত অনেক অর্থ ব্যয় করলেন কিন্তু এই ছবি হেমন্তকে ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দিতে পারল না । প্রবল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লেন হেমন্ত ।  কিন্তু প্রবল জেদ নিয়ে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে হেমন্ত করলেন, ‘মজলি দিদি’ (মূলকাহিনী শরৎ চন্দ্র চট্টপাধ্যায়, নায়িকা মীনাকুমারী), ‘বিবি আউর মকান’ কিন্তু একটা ছবিও চলল না । এরপর ‘খামোশী’ ছবিটি কিছুটা সাফল্য এনে দিয়েছিল ।   হেমন্তর প্রযোজিত শেষ ছবি হল ‘বিশ সাল পহলে’, যার নায়ক হলেন নিজের ছেলে জয়ন্ত । ছবির জন্য জয়ন্তর নাম হয়েছিল রিতেশ কুমার । কিন্তু হায়, এই ছবিও চলল না । হেমন্ত বুঝলেন ছবি প্রযোজনা তাঁর কাজ নয় ।   এদিকে তখন হেমন্তর কয়েক লক্ষ টাকা ধার ।  

এই ধার শোধ করতে হেমন্ত এবার ছবি পরিচালনার কাজে হাত দিলেন । ছবিতে তিনিই প্রযোজক, চিত্রপরিচালক ও সংগীত পরিচালকও বটে ।   সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর গল্প ‘অনন্যা’ –এর উপর নির্ভর করে তৈরি করলেন বাংলা ছবি ‘অনিন্দিতা’ । শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও মৌসুমী নায়ক নায়িকা । এ ছবি মোটামুটি চললেও গানগুলি খুব হিট করেছিল ।  ছবিতে ‘ওগো নিরুপমা’ (https://www.youtube.com/watch?v=WVpa0PJa3zE) গানটি হেমন্ত কিশোরকুমারকে দিয়ে গাইয়ে ছিলেন নিজে একটি অসাধারন রবীন্দ্রসংগীতও গেয়েছিলেন, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ (https://www.youtube.com/watch?v=wvXZ_bw7HiM)  । ছবিতে লতারও একটি খুব সুন্দর গান ছিল ‘ও রে মনপাখী’ (https://www.youtube.com/watch?v=4ygGf-ulxMg) ।
 
এরপর তিনি হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন হাউসের ইতি টেনে ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা থেকে বেরিয়ে এসে সংগীত পরিচালনা ও প্লে ব্যাকে মন দিলেন । সৃষ্টি হল একের পর এক কালজয়ী গানের সুর । হেমন্ত খুব ভাল করেই বুজতেন  কোন কাজটা তাকে দিয়ে হবে আর কোনটা তাকে দিয়ে হবে না । গানের মধ্যে সুরের বেশী কালোয়াতি ও কারুকার্য তিনি অপছন্দ করতেন ।  ‘রাগ অনুরাগ’ ছবিটি যখন হয়, তখন পরিচালক দীনেন গুপ্ত একটা গান দেখিয়ে হেমন্তকে বলেছিলেন, ‘হেমন্তদা এই গানটা কোন রাগের উপর করলে ভাল হয়’ ? হেমন্ত বলেছিলেন , “আমি রাগের কিছু বুঝি না” অথচ মুখে বললেও ওই ছবির ‘কি গান শোনাব বলে ওগো সুচরিতা’ (https://www.youtube.com/watch?v=BVU9J4EIwxs)  গানটি হেমন্ত গেয়েছিলেন মালকোষ রাগের উপর । 

দিল্লীতে একটা অনুষ্ঠানে হেমন্ত গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে । কিন্তু তাঁর সেই আদি অকৃত্রিম পোশাক সাদা হাত গোটান শার্ট ও ধুতি । অনুষ্ঠান মঞ্চের গেটের সামনে সিকিউরিটি তাকে চিনতে না পেরে আটকে দিলেন । হেমন্ত ফিরে গেলেন হোটেলে । জানতে পেরে ইন্দিরা গান্ধী নিজে গাড়ি পাঠালেন হেমন্তকে হোটেল থেকে নিয়ে আসার জন্য । হেমন্ত বলে পাঠালেন ‘আপনার অনুষ্ঠানে আমার শুভেচ্ছা রইল । কিন্তু হেমন্ত মুখারজি একবার যেখান থেকে ফিরে আসেন সেখানে তিনি দ্বিতীয় বার যান না । এই প্রখর আত্মসন্মান বোধ হেমন্তকে সাহায্য করেছিল গানের জগতে এক কিংবদন্তিতে পরিনত করতে ।  ‘খামশী’ ছবির প্রেস মিটিং এ তাঁকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল, “হেমন্তদা আপনি এই ছবিতে এতো ভাল সুর করেছেন কিন্তু ‘ও সাম কুছ আজিব থি’ (https://www.youtube.com/watch?v=MDXFi3avqo0) গানটি আপনি নিজে না গেয়ে কিশোরকুমারকে দিয়ে দিলেন কেন”? হেমন্ত মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, “আমি কিশোরের মতো ওত সুন্দরভাবে গাইতে পারতাম না । গানটা শুধুমাত্র কিশোরের জন্যই তৈরি” । অর্থাৎ ছবির গানের শিল্পী যখন নির্বাচন করতেন, তখন ছবির সিকোয়েন্সের কথাই আগে ভাবতেন । শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শেষ কথা । তাই ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিতে সুজাতা চক্রবর্তির মতো একজন আনকোরা শিল্পী দিয়ে তিনি গাইয়েছিলেন “ভুল সবই ভুল” (https://www.youtube.com/watch?v=63IL8sneE34)                               
পরিচালক তরুন মজুমদারের সাথে হেমন্তর গাঁটছড়া বাধে ১৯৬৩ সালে ‘পলাতক’ ছবির মাধ্যমে ।  ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’, ‘দোষ দিও না আমায় বন্ধু’, ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে’ গানগুলি খুব জনপ্রিয় হয় এবং যা মুকুল দত্ত কে বাংলা ছবির একজন সফল গীতিকার হিসাবে পেয়েছিল (https://www.youtube.com/watch?v=Dyb3RTzV-Co)    ‘পলাতক’ ছবির পরবর্তী কুড়ি বছরের সিনেমার গানে বহু সোনালি ফসল দিয়েছে ।  এরপর থেকে প্রায় প্রত্যেক বছরই হেমন্তর সুরে জন্ম হয়েছে অন্তত একটি করে সুপারহিট গানের ছবি । 

প্লে ব্যাক গাইয়ে হেমন্ত সহজ সাবলীল ভঙ্গীতে কত বিচিত্র মেজাজের গানই না গেয়েছেন । একদিকে ‘ভোট দিয়ে যা আয় ভোটার আয়’ (দাদাঠাকুর), শ্যামল মিত্রের সাথে ‘এই খেয়া বাইব কত আর’ (খেয়া), ‘লাজবতী নুপুরের রিনিঝিনি’ (নতুন জীবন), ‘কে জানে ক ঘণ্টা পাবে রে জীবনটা’ (সোনার খাঁচা), ‘ঘুম যায় ওই চাঁদ’ (মায়ার সংসার), ‘রাজার দুলালী সীতা বনবাসে যায় রে’ (চন্দ্রনাথ), ‘নিলামবালা ছআনা’ (পৃথিবী আমারে চায়), তিনিই নিজেকে পাল্টে নিয়েছেন ‘আজ হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি, ভুল সবই ভুল’ (বালুচরি) গাইতে গিয়ে । ‘আমার এ হরিদাসের বুলবুলভাজা’ (বাড়ি থেকে পালিয়ে), বা ‘আয় আয় আশমানী কবুতর’ (বাঘবন্দী খেলা) যিনি গাইছেন সেই হেমন্তই সম্পূর্ণ অন্য রকম ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’ (স্ত্রী) গাইতে গিয়ে । নিজের সামর্থ্য ও স্টাইলের মধ্যে থেকেই এভাবে বৈচিত্রে পূর্ণ হয়ে উঠেছেন প্লে ব্যাক গাইয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ।  

তাঁর প্রানের আরাম রবীন্দ্রসংগীতকেও কাজে লাগিয়েছেন বিভিন্ন ভাবে ছবিতে ।  জীবনের শেষ পর্বে তরুন মজুমদারের তিনটি ছবি ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ এবং ‘পথভোলা’ ইত্যাদি ছবিগুলিতে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ।  গানগুলি সুপার ডুপার হিট ।  ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে একটা প্রার্থনা সংগীত ছিল – ‘এসো প্রাণ ভরণ দৈন হরন হে’ (https://www.youtube.com/watch?v=GJ8Hq9Hu3fs )  – এই গানটিতে হেমন্ত এমন একটা সুরসৃষ্টি করেছিলেন যে গানটি শুনে মনে হত এটি কোন দ্বিজেন্দ্রগীতি অথবা অতুলপ্রসাদের গান ।  হেমন্তর সুরের সার্থকতা এখানেই ।  তরুন মজুমদারের আর একটি ছবি ‘অমরগীতি’ তেও এসেছে পুরাতনী টপ্পা গান ।  গানগুলি হেমন্ত গাইয়েছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায় ও রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে ।  

আটের দশকের গোড়া থেকেই ফিল্ম বা আধুনিক গানের পরিবেশ পাল্টাতে শুরু করেছিল । বাংলায় সেইসময় রাহুল দেববর্মণ ও বাপ্পি লাহিড়ী জাঁকিয়ে বসলেন ।  আর সেই সূত্রে কিশোরকুমার চলে এলেন একেবারে প্রথম সারিতে ।  তখন বৈচিত্র আনার জন্য বাংলার চিত্রপরিচালকরা প্রায় সবাই বোম্বাইয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন ।  এই সময় হেমন্ত অত্যাধিক ফাংশান, রেকর্ডিং এর ধকলে পরিশ্রান্ত ।  ছায়াছবির কাজও নিয়মিত ভাবে খুব একটা করে উঠতে পারছিলেন না ।  অসুস্থতার জন্য করতে পারলেন না ‘সাহেব’ ছবির দুটো গান, যেটি সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় পরে  দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাইয়েছিলেন ।       
                      
তরুন মজুমদারের ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবির জন্য গান লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় । ছবির নায়কের সব গানগুলো হেমন্ত রেকর্ড করলেন । নায়িকার লিপের গানগুলো গাইলেন হৈমন্তী শুক্লা । তরুন মজুমদার গানগুলো শুনে পুলকবাবুকে বললেন, “হেমন্তবাবু গানগুলি খুব ভাল গেয়েছেন, কিন্তু আমার নায়ক তাপস পাল অল্পবয়সী তাই হেমন্তবাবুর কণ্ঠস্বরটা একটু বয়স্ক লাগছে” ।  হেমন্তবাবু শুনলেন এবং অনুভব করলেন বাস্তব পরিস্থিতিটা ।  পুলক জানালেন যে বারাসাত-এ একটি ছেলে আছে যে নাকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর খুব ভক্ত এবং কণ্ঠস্বরও অনেকটা হেমন্তবাবুর মতো ।  খুব লড়াই করছে গানের জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে ।  ইতিমধ্যে অজয় দাসের সুরে একটি ছবিতে গানও গেয়েছে খুব ভালো ।  ছেলেটির নাম শিবাজী চট্টোপাধ্যায় । হেমন্ত ডেকে পাঠালেন শিবাজীকে ।  গান তোলা হল এবং রেকর্ড হল ।  ছবি ও ছবির গান সুপার হিট ।  শিবাজীর সংগীত জীবনের মোড় ঘুরে গেল । সবাই তাকে ছোট হেমন্ত বলে ডাকতে শুরু করলেন ।  ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবির জন্য হেমন্ত পেলেন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার ।  যখন পরিচালকরা বোম্বাই যাচ্ছেন সংগীত পরিচালক ধরার জন্য, সেই সময় হেমন্ত কোলকাতার শিল্পীদের নিয়ে বাজার মাত করলেন ।    সাধারণত সংগীত পরিচালকরা ছবির ক্লাইম্যাক্সে কোন গান রাখতে ভরসা পেতেন না, কিন্তু হেমন্ত এই ছবিতে প্রায় ৯ মিনিটের একটি কাহিনীসংগীত রেখে প্রমান করে দিলেন যে এটার যথাযথ প্রয়োগ ছবিকে একটা মান্যতা দেয় ।   ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবির দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিল শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের গলায় সেই বিখ্যাত গান ‘অভাগা যেদিকে চায়’ (https://www.youtube.com/watch?v=ypmwmgGVe70 )
এরপর থেকেই  শিবাজী হেমন্তর সুরে প্রায় সব ছবিগুলোতেই নায়কের লিপে গান গাইতে লাগলেন । এই সময় ছবির প্রয়োজনে নিজেকে প্লেব্যাক থেকে সরিয়ে নিলেন হেমন্ত । তাঁর কাছে সিকোয়েন্সের ডিম্যান্ডটাই বড়, নিজের ব্যাক্তি স্বার্থের থেকে ।  

অতিরিক্ত পরিশ্রমে হেমন্তর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করেছিল । সেই ষাটের দশক থেকেই তাঁর দুরারোগ্য কোমরের ব্যাথা তাঁকে একেবারে কাবু করে দিয়েছিল । এর পাশাপাশি আক্রমন করে অ্যালার্জি, ডায়বেটিস, হৃদরোগ ।  তবুও ভগ্নস্বাস্থ্য তাঁর কণ্ঠরোধ করতে পারেনি ।  বারবারই তিনি বলতেন যতদিন বাঁচবো ততদিন যেন গলা ছেড়ে গান গাইতে পারি, এটাই আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে ।  ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেন নি । মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে গান গেয়ে গেছেন ।  জীবনের শুরু থেকেই হেমন্ত পেয়েছেন ঈশ্বরের অকৃপণ দান । কণ্ঠ ভরে গান দিয়েছিলেন বিধাতা । দিয়েছিলেন, সংসারের সব কিছুর মধ্যে সুর খুঁজে নেবার বিরল ক্ষমতা ।  হেমন্তবাবুর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’ যাঁদের পড়া তাঁরা মনে করতে পারবেন কোন শিশুকাল থেকেই তাঁর কণ্ঠে সুর এবং সুর চেনার ক্ষমতা ।  একেবারে শৈশবে বিধাতার এই আশীর্বাদ এসেছে তাঁর মায়ের মধ্যে দিয়ে । হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় সুর করে হেমন্তকে ঘুম পাড়াতেন মা ।  ‘আমার গলায় সুরের জন্ম বোধহয় তখন থেকেই ।  মা যেন শিশুকে ঝিনুকে করে দুধ খাওয়ানোর মতো করে সুর ঢেলে দিয়েছিলেন আমার গলায়” – এ প্রসঙ্গে লিখেছেন তিনি ।  

সুরের ব্যাপারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বয়ংবৃত ‘সুরের গুরু’ রবীন্দ্রনাথ ।  ‘কোন বানীর কি সুর হওয়া উচিত সেটা পেয়েছিলাম ওই রবীন্দ্রনাথের গান থেকে ।  রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য শুনেছি বিভোর হয়ে ।  মনে হয়েছে এটাই সর্বকালের সর্বযুগের সেরা সৃষ্টি’। সুরগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এটাই বার বার বলে গেছেন হেমন্ত ।  রবীন্দ্রসংগীতকেই তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত জেনেছিলেন শেষ পারানির কড়ি হিসাবে । 
১৯৮৭ সাল হেমন্তর জীবনের একটি স্মরণীয় সময় ।  হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংগীত পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল ‘লালন ফকির’ ছবিটি ।  এই ছবিতে লালনবেশী অসীমকুমারের লিপে সবকটি গানই গেয়েছিলেন হেমন্ত এবং বলাই বাহুল্য ছবির বেশীর ভাগ গানই লালনগীতি (https://www.youtube.com/watch?v=FSHbYS2w4ZA)    এই গানই তাঁকে এনে দিল রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ।  এর সূত্র ধরেই হেমন্ত পেয়েছিলেন রবীন্দ্রভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্মানিক ডি-লিট ।   

১৯৮৮ সালে তরুন মজুমদারের ‘আগমন’ ছবিতে সুরারোপ করেন হেমন্ত । ছবির সব গান  শিবাজী চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে রেকর্ডিং করার পর হেমন্ত ওই ছবিতে স্বকণ্ঠে দুটি গান গাইবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ।  পরিচালক তরুন মজুমদার সানন্দে রাজি হলেন । দুটো গান রেকর্ড হল । একটি গান ডুয়েট আশা ভোঁসলের সঙ্গে – ‘ঢাক গুর গুর গোপন কথা বলি’ অপর গানটি হেমন্তর একক কণ্ঠে ‘এতো ভালোবাসা নয়’ (https://www.youtube.com/watch?v=UZSPIJPGmJo )  এই গানের মাধ্যমে হেমন্ত আর একবার বুঝিয়ে দিলেন শারীরিক অসুস্থতা তাঁর মনের জোরকে  একেবারে কাবু করতে পারেনি ।  

১৯৮৯ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর হেমন্ত বাংলাদেশে এলেন মধুসূদন পুরস্কার নিতে ।  ১৪ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকায় ছিলেন এবং এই সময় তাঁকে যেমন তিক্ত অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে তেমনি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা, প্রীতি ও শ্রদ্ধা তাঁকে অভিভূত করেছে ।  পুরস্কার গ্রহনের দিন ঢাকার মানুষের অনুরোধে হেমন্ত গাইলেন মোট ছয়টি গান এবং একটি গান গাইলেন কন্যা রানুর সঙ্গে ।  গান শুরুর আগে হেমন্ত করজোড়ে নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা জানালেন গান চলাকালীন কোন ত্রুটি হলে যেন শ্রোতারা যেন মার্জনা করে দেন । এরপর একে একে গাইলেন, ‘এই মনিহার আমার নাহি সাজে’, ‘রানার’, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘শুধু তোমার বানী নয়গো হে বন্ধু হে প্রিয়’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ ইত্যাদি সব কালজয়ী গান । 

ঢাকা থেকে ফেরার দিন একটা ঘটনা ঘটল ।  সেইদিন সকালে এক ভদ্রলোক হেমন্তকে ধরলেন তাঁর নতুন খোলা রেকর্ড কোম্পানিতে অন্তত একটি গান রেকর্ড করে দেবার জন্য ।  এড়াতে পারলেন না হেমন্ত ।  ওই অসুস্থ শরীরে জীবনের শেষ আধুনিক গান রেকর্ড করলেন – ‘ভালো করে মেলে দেখ দৃষ্টি, বুঝবে বাংলাদেশ বিধাতার কত বড় সৃষ্টি’। 

বাংলাদেশ থেকে ফিরে চরম শরীর খারাপের মধ্যেও ১৯৮৯ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর শেষ ফাংশন করলেন কোলকাতার কলামন্দিরে ।  এই সময় বিশ্বজিতের প্রযোজনায় ‘ভালবাসার রাত’ নামক একটি ছবিতে সুর ও গান করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন হেমন্ত ।  সঙ্গে সহকারী হিসাবে নিয়েছিলেন নিজের ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায়কে ।  ২৫ শে সেপ্টেম্বর এই ছবির একটি গান রেকর্ডিং করেন হেমন্ত ।  আর এইসঙ্গে রেকর্ড করেন স্বপন চক্রবর্তির সুরে ‘চন্দ্রনাথ’ নাটকের গান ‘জীবনের নাট্যশালায়’ এবং ‘পাখীটা উড়ে যাবে’ । জীবনের শেষ রেকর্ডিং ।  পরের দিন ২৬ শে সেপ্টেম্বর রাত ১১ টা বেজে ১৫ মিনিটে জীবনের ৬৯ ও সংগীত জীবনের ৫৪ বছর পূর্ণ করে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ।   বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হিসাবে তিনি নিজেকে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বেসিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, সিনেমার গান, সংগীত পরিচালনার বহুমুখী ভূমিকায় এবং বঙ্গদেশের এতাবৎকালের সাংগীতিক ইতিহাসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তারি ও সফল ব্যক্তিত্ব ।     চিরকাল অত্যন্ত সাধারন বাঙ্গালী জীবনের প্রতীক হেমন্ত  বাঙ্গালী মানসিকতা, বাঙ্গালির মূল্যবোধ কে সযত্নে লালন করে গেছেন নিজের অন্তরে ।  জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে দক্ষিন কলকাতার  রুপনারায়ন নন্দন লেনের একচিলতে গলি থেকে পা রেখেছেন মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় মোড়া রাজপথে ।  আর তাই আজও সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন হেমন্ত ।  থাকবেন আরও বহু বৎসর । 
    
তথ্যঋণঃ
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’,  দেশপত্রিকা, একদিন নবপত্রিকা, আনন্দলোক, ইন্টারনেট ও ইউটিউবে প্রকাশিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নানা সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণ ।