Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১

চেনা গানের অজানা কথা ৫

 

 কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল

১৯৫৩ সালের কোন একটা সময়ে মুম্বাইয়ের একটা রেকর্ডিং স্টুডিয়ো ফ্লোরে বেশ একটা টান টান উত্তেজনা। লতা মঙ্গেশকর আসবেন তাঁর জীবনের প্রথম বাংলা আধুনিক গানের রেকর্ডিং-এর জন্য, যেটা সেই বছর পূজোতে রিলিজ করবে।  গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারও উপস্থিত আছেন ফ্লোরে। তিনি বেশ চিন্তিত। লতার মতো একজন ব্যস্ত শিল্পীকে দিয়ে রেকর্ডিং করা বেশ দুরূহ কাজ।  গানের সুরকার,  মিউজিসিয়ানদের নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে কোন রকম ভুলচুক না হয় কারণ লতাজি খুব ব্যস্ত একজন শিল্পী। সময় বয়ে যায় কিন্তু তাঁর যে দেখা নেই।  কিছুদিন আগেই লতাজিকে গানটি পুরো তুলিয়ে দিয়েছেন সুরকার।  আজ ফাইনাল রেকর্ডিং–এর দিন।  সব কিছু রেডি কিন্তু লতাজি যে এখনো এসে পৌঁছলেন না।   অবশেষে দিনের শেষে লতাজি খবর পাঠালেন অন্য একটি জরুরী রেকর্ডিং-এর কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি সেই দিন উপস্থিত থাকতে পারলেন না। অনুগ্রহ করে লতাজিকে অন্য কোনদিন যেন ডেট দেওয়া হয়।  

পরবর্তী ডেট-এও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোল।  এবার সুরকার গেলেন রেগে। তিনি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন।  তিনি তো আর এলেবেল লোক নন। তাঁর রক্তে আছে একটা সাংগীতিক ঘরানা।  ইতিমধ্যেই এই সুরকার ছবিতে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবেও যথেষ্ট নাম করেছেন। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বোঝালেন লতাজি খুবই ব্যস্ত মানুষ হয়তো আগের মতোই তিনি আবার কোন সাংগীতিক ক্রিয়া কর্মে জড়িয়ে গেছেন, তাছাড়া এই লাইনে এইসব আকছার হয়।  কিন্তু তিনি এইসব যুক্তি মানতে চাইলেন না।  তিনি একসময় গোবর গুহর কুস্তির আখড়ায় তিনি রীতিমত শরীরচর্চা করতেন।  শারীরিক দিক ছাড়াও মানসিক দিক থেকেও তিনি যথেষ্ট বলিষ্ঠ।  শুধু তাই নয়, কয়েকবছর আগে  স্বয়ং লতাজীই সেই সুরকারকে বলেছিলেন তাঁর  বাংলা গানের প্রতি ভালোবাসার কথা এবং ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর সুরে ও গৌরীবাবুর লেখায় তিনি তাঁর জীবনের প্রথম বাংলা আধুনিক গান রেকর্ড করতে চান।  ঠিক করলেন লতাজিকে বাদ দিয়েই অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়ানো হবে গৌরীবাবুর লেখা এই দুটি গান।    রেকর্ড কোম্পানির এক কর্তা সেই সুরকারকে প্রস্তাব দিলেন তাহলে এই দুটি গান কোন ফিমেল ভয়েসে নয়, মেল ভয়েসে রেকর্ডিং হবে । আর সেটার গায়ক যদি স্বয়ং সুরকার হয় তাহলে রেকর্ড কোম্পানির তেমন কোন লোকসান হবে না, তাছাড়া সেটিই হবে সেই বাঙ্গালী গায়ক ও সুরকারের রেকর্ডেড প্রথম বাংলা আধুনিক গান।  গীতিকার গৌরীপ্রসন্নও এই প্রস্তাবে একমত হলেন।  অবশেষে রেকর্ড হোল ১৯৫৩ সালের পূজোয় রিলিজ হওয়া সেই দুটি কালজয়ী গান।  ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’।  দ্বিতীয় গানটির সুরের ব্যাপারে সেই সুরকার জানিয়েছিলেন যে গানটিতে একটি ইংরেজি গানের কিছুটা সুরের ছোঁয়া আছে, যেটি উনি শিখেছিলেন তাঁরই দক্ষিণভারতীয় স্ত্রীর কাছে।  ‘I was dancing with my darling’ – গানটি একদিন গুনগুন করে গাইবার সময় গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন বলেছিলেন এই সুরের উপর তিনি গান লিখবেন। লিখেছিলেন এই গানটি , ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’।  জানি, ইতিমধ্যেই আপনারা বুঝে ফেলেছেন যে সেই গায়ক ও সুরকারের নাম।  একদম ঠিক, তিনি প্রবোধ চন্দ্র দে,  অর্থাৎ  আমাদের প্রিয় শিল্পী মান্না দে।  আর এই দুটি গানের অর্কেস্টেশন করেছিলেন ভি বালসারা।  সেই সময় বালসারাজি মুম্বাই-এ শঙ্কর জয়কিশেন প্রায় প্রত্যেক ছবিতে হারমোনিয়াম বাজাতেন এবং তিনি  এইচ  এম ভি-এর সাথে যুক্ত ছিলেন।  গানদুটি হিট হওয়ায় এইচ এম ভি-এর প্রত্যয় হোল যে এই মান্না নামের ছেলেটি তাঁর কাকার যোগ্য উত্তরসূরী। এর পর থেকে প্রায় প্রত্যেক বছর এইচ এম ভি-এর পূজোর গানের তালিকায় মান্না দে-র নাম থাকত সংগীতশিল্পী হিসাবে। এই গৌরীপ্রসন্ন-মান্না দে জুটিই আমাদের উপহার দিয়েছে দুর্দান্ত কিছু বাংলা আধুনিক গান যেমন, ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড়’, ‘তুমি আর ডেকো না, পিছু ডেকো না’ এবং অবশ্যই জনপ্রিয় ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ (সুরঃ সুপর্ণকান্তি ঘোষ)।    

মান্না দে ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
শেষ করার আগে আরও একটা তথ্য দিয়ে রাখি, এর ঠিক কয়েকবছর পর শিল্পী ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ালেন লতাজীর জীবনের প্রথম আধুনিক বাংলা গান পুজোর জন্য।  ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, আর এই গানের কথাও লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।  ১৯৫৭ সালে রিলিজ হওয়া এই গানও খুব হিট করেছিল।    আর এর ঠিক কয়েকবছর পর অর্থাৎ ১৯৬১ সালে হেমন্তবাবু এই গানের সুর ব্যবহার করলেন তাঁরই সুরারোপিত একটি হিন্দী ছবিতে। গানের কথা লিখলেন সাহির লুধিয়ানভি এবং ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ এই গানের হিন্দী ভার্সনটি গাইলেন কিশোর কুমার। বলা বাহুল্য এই ছবিতে কিশোর ছিলেন নায়ক ও নায়িকা ছিলেন ওয়াহিদা রেহমান। ছবির নাম ‘গার্লফ্রেন্ড’।   

             

 

                                                         কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল 

 

                                                       হায় হায় গো রাত যায় গো

                                                      প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে 

 

                                       ‘গার্লফ্রেন্ড’ ছবির সেই গান যেটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার

 

বিশেষ ঋণঃ ফিল্মফেয়ার পত্রিকা, সুরসম্রাট মান্না দে – সংকলন ও সম্পাদনা – মানস চক্রবর্তী  

প্রবীর মিত্র

২৩/০৩/২০২১

৮টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

চমৎকার তথ্য। সমৃদ্ধ হলাম বন্ধু.......

Unknown বলেছেন...

খুব ভাল লাগল এমন তথ্য পেয়ে |

নামহীন বলেছেন...

পরিচিত বাংলাগানের বেশ কিছু অজানা তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য আপনাকে জানাই কুর্নিশ। - জয়দীপ সেনগুপ্ত।

Probir's Feel Notes বলেছেন...

সব্বাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

chandan বলেছেন...

এরকম না লিখলে পুরোনো ইতিহাস গুলো একসময় চাপা পড়ে
যাবে।তাই আরও লেখো আর আমাদের সমৃদ্ধ করো।

Chandana বলেছেন...

অনেক জ্ঞান অর্জন করলাম। খুব ভালো লাগল।

Probir's Feel Notes বলেছেন...

সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

Probir's Feel Notes বলেছেন...

ধন্যবাদ চন্দন। তোমাকে এই ব্লগের অন্য লেখাগুলো পড়ার অনুরোধ রাখছি।