Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

সোমবার, ৭ জুন, ২০২১

বিকাশ কথা - ২

 

বিকাশ কথা

  

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে কলঙ্ক আছে বলেই চাঁদ এত সুন্দর। পাঁকে সে ফোটে বলে তাই সে পঙ্কজ। খলনায়ক ছাড়া কোন সিনেমায় নায়ক অসম্পূর্ণ।  অবশ্য সেই খল মুখোশের চোখেও থাকে জল। একজন খলনায়কও দর্শকের মনের আসনে অনেকখানি জায়গা করে নিতে পারেন।  আমরা সদ্য পেরিয়ে এলাম সত্যজিৎ রায় মশাই-র জন্মশতবর্ষ, অথচ বাংলা চলচ্চিত্রের অপর এক রায়মশাই-ও তাঁর জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে এসেছেন প্রায় বছর পাঁচেক হল।  গত ১৬ই মে ছিল বাংলা ছবির নায়ক হবার সব গুণ থাকাসত্ত্বেও প্রতিনায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক বিকাশ রায়ের ১০৫ তম জন্মদিন (জন্ম ১৬ই মে ১৯১৬) । আজ এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করব এই প্রতিনায়কের বেশ কিছু মুহূর্তের কথা। আজ দ্বিতীয় পর্ব। কেমন লাগলো জানালে খুব ভালো লাগবে।   যদি প্রথমপর্ব এখনো পড়া না হয়ে থাকে তাহলে এখানে ক্লিক করুন   

 

গত পর্বেই উল্লেখ করেছিলাম ১৯৫১ সালটা ছিল বিকাশের জীবনের একটা টার্ন পয়েন্ট, কারণ এই বছরেই বাংলা ছবির দর্শক পেয়েছিল তাঁর অভিনীত তিনটি সাড়াজাগানো ছবি ‘বেয়াল্লিশ’, ‘রত্নদীপ’ ও ‘জিঘাংসা’, যার মধ্যে ‘জিঘাংসা’ ছবিতে তিনি কিছু অর্থও নিয়োজিত করেছিলেন।  যথারীতি ‘জিঘাংসা’ দর্শকমহলে সুপারহিট হবার পর বিকাশের মনে একটা নেশা ধরে গেল ছবি প্রযোজনা করার।  বিখ্যাত পরিচালক চিত্ত বসুকে সঙ্গে নিয়ে ও অভিনেত্রী সন্ধ্যারানি-কে নায়িকা করে ‘শুভযাত্রা’ নামে একটি ছবির প্রযোজনা করলেন। কিন্তু এই ছবি তেমন একটা হিট হোল না আর এতে জেদ ধরে গেল বিকাশের, তৈরি করলেন ‘বিকাশ রায় প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’।

বিকাশ রায়

এবার তিনি পরিচালক অজয় কর আর নায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে প্রযোজনা করলেন ‘সাজঘর’ নামে একটি ছবি।  এই ছবি এবার একটু সাফল্যের মুখ দেখল।   তিনি ভাবলেন এবার পরিচালনার কাজটা নিজেই করবেন এবং ১৯৫৫ সালে শুরু করলেন ‘অর্ধাঙ্গিনী’ নামে একটি ছবির পরিচালনার কাজ।  ছবিতে তিনি পরিচালক, প্রযোজক এবং প্রধান চরিত্রের অভিনেতা আর অন্যান্য ভূমিকায় রইলেন নির্মলকুমার, অসিতবরন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মঞ্জু দে, ভারতী দেবী ও পাহাড়ি সান্যাল। ছবি মোটামুটি হিট হবার পর তিনি গজেন্দ্রকুমার মিত্রের একটি গল্প, ‘সূর্যমুখী’-এর চিত্রনাট্য লিখলেন বিকাশ, নিজে পরিচালনা করবেন বলে।  ১৯৫৬ সালে রিলিজ হোল ‘সূর্যমুখী’, যার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সন্ধারানি, অভি ভট্টাচার্য, ছবি বিশ্বাস, চন্দ্রাবতী দেবী। এছাড়া পরিচালক বিকাশ এই ছবির একটি বিশেষ চরিত্রে ছিলেন।  ছবি বেশ হিট তাছাড়া এই ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি গান আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে, ‘আকাশের অস্তরাগে আমারই স্বপ্ন জাগে’। 

 

দেশ পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন বিকাশ। সেই সময় দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হত প্রমথনাথ বিশীর উপন্যাস, ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’। উপন্যাসটির সমকাল ছিল ভারতের ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগ আর বাংলা ভাষা প্রসারে উদ্যোগী ইংরেজ পুরুষ উইলিয়াম কেরী ও তাঁর দেওয়ান রামরাম বসুকে নিয়ে।  এই উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে পড়ার সময় থেকেই বিকাশের মাথায় ছিল এটিকে চিত্রনাট্যের আকার দিয়ে তিনি ছবি করবেন। মনে রাখতে হবে ১৯৬১ সালে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে এই ছবির কাজটা করা ছিল বেশ দুঃসাহসিক কাজ এবং ব্যয়সাপেক্ষও বটে।   তাঁর আত্মজীবনীতে জানা যায়, ছবির পরিচালনার আগে তিনি ছবির সময় ও ব্যাক্তিবর্গদের সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশুনা করতেন।  

বিকাশ রায় অভিনীত ছবির পোস্টার

ছবির চিত্রনাট্য লেখার সময় নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য ছুটে যেতেন কোলকাতা শহরের ছোট বড় বিভিন্ন লাইব্রেরীতে।  দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে এই বিষয়ে তাঁর অশেষ কৃতজ্ঞগতার কথাও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেন নি। অবশেষে তাঁর পরিশ্রম সাফল্যের মুখ দেখেছিল।  সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে এই ছবির হিট গানগুলো গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।  ছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা একটি গান ‘কি হোল রে জান, পলাশী ময়দানে নবাব হারল তাঁর প্রাণ’ অসাধারন গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র।    

বিকাশ রায় অভিনীত ছবির পোস্টার

নিজে গান না গাইলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। ১৯৬৯ সালে তাঁর পরিচালিত ‘বসন্তবাহার’ ছবিটি তার মস্ত বড় একটি উদাহরণ। অনিলবরন ঘোষের লেখা একটি ছোটগল্পের ছায়া অবলম্বনে এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বসন্ত চৌধুরী ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যেহেতু ছবির গল্প পুরোপুরি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নির্ভর তাই তিনি সঙ্গীত পরিচালনার দ্বায়িত্ব দিলেন বন্ধুপ্রবর পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে, কারণ ছবিতে প্রচুর গান, বাজনা, নৃত্যের দৃশ্য থাকবে, তাই কোন রকম ফাঁকিবাজি করা চলবে না দর্শকের সাথে।  সেই মুহূর্তে বিকাশের তাঁর নিজের বন্ধু জ্ঞানবাবু ছাড়া আর অন্যকোন সঙ্গীত পরিচালকে ভাবতে পারেন নি।   জ্ঞানবাবুর সুপারিশে ছবিতে কণ্ঠদান করার জন্য বিকাশ আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, ওস্তাদ আমীর খান, হীরাবাঈ বরদেকর, মানিক বর্মা, এ কানন, প্রসূন বন্ধোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ তাবড় তাবড় ভারত বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের।  ছবির একটি দৃশ্যে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী রোশনকুমারী ও  তবলাবাদক শান্তাপ্রসাদকেও দেখা যায়।  যথারীতি ছবির গল্পের পাশাপাশি ছবির গানগুলোও সুপারহিট। এই ছবিতে একটি গান রেকর্ডিং নিয়ে একবার একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল ।  

 

বিকাশ রায় অভিনীত ছবির পোস্টার

ছবিতে পণ্ডিত বড়ে গোলাম আলি সাহেব তাঁর বিখ্যাত ‘ক্যা করু সজনি, আয়ে না বালম’ গানটি রেকর্ডিং এর সময় তিনি বলে বসলেন, ‘স্টুডিয়োর সব দরজা জানলা খুলে দাও, এইভাবে বদ্ধ অন্ধকার ঘরে রেকর্ডিং করলে আমার মেজাজ আসবে না’।   সে এক কাণ্ড বটে। স্টুডিয়োর সবাই তটস্থ। ভাগ্য ভালো সেই সময় ওত সকালে গাড়ীর উপদ্রব তেমন ছিল না তাও সাবধানতার জন্য বিকাশ তাঁর দলের লোকেদের অনুরোধ করলেন যাতে রাস্তায় নেমে কিছুক্ষনের জন্য গাড়িগুলোকে আটকে রাখেন।  এমনকি যাতে একটা কাকও যাতে কর্কশ গলায় না ডেকে উঠে সেইজন্য সবাই মনে মনে ইস্টজপ করতে লাগল।  খান সাহেব আপনমনে কিছুক্ষন রেওয়াজ করে আসল গানটি রেকর্ড করলেন।  সবাই খুব খুশী, অসাধারন গেয়েছেন খান সাহেব, তদুপরি বাইরের আওয়াজও ঠেকান গেছে।  কিন্তু ফাইনাল রেকর্ডিং শুনে বিকাশের মাথায় হাত। সিনেমায় সাধারণত হাল্কা গান হয় মনে করেই আলিসাহেব খুব হাল্কা মেজাজে গানটি গেয়েছেন যা ছবির চিত্রনাট্যের সাথে পুরোপুরি বেমানান।  কিন্তু খান সাহেবকে বোঝায় কার সাধ্য । তিনি বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। বিকাশ একরকম মরিয়া তাঁর পায়ে পড়ে বললেন, “খান সাহেব আপনার গানের কোন তুলনা নেই, আমি হিন্দিটা খুব একটা ভালো জানি না, আপনি আমাকে দয়া করে যদি একটু সময় দেন তাহলে এই ছবির গল্পটা আমি আপনাকে ছোট্ট করে বলছি”। খান সাহেব বেশ বিরক্ত।  তাও তিনি অনুমতি দিলেন। বিকাশ জানালেন আপনার গানটি ছবিতে আমার নায়কের লিপে থাকবে যখন প্রিয়াবিরহে সে দেশে দেশে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, ‘ক্যা করু সজনি, আয়ে না বালম’ বন্ধু কি করি, আমার প্রিয়া যে এল না’।  গানটি ঠিক কোন জায়গায় লাগানো হবে তার সিচুয়েশন কি তাও বিকাশ তার আধো হিন্দিতে প্রাণপনে বোঝাতে চেষ্টা করলেন।  সবাই অবাক, কিছুটা বিরক্ত, গান রেকর্ডিং শেষ হয়েছে, খান সাহেব বাড়ি যাবেন, বিশ্রাম করবেন, রাত্রে আবার একটা জলসায় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন, আর বিকাশ এর মধ্যে কি শুরু করল।  গল্প শোনার পর সবাইকে অবাক করে খান সাহেব বিকাশকে বললেন, ‘এই গল্প তুমি আমাকে আগে বলনি কেন ভাই ?’ আমি যা গেয়েছি তাতো একেবারেই এই ছবির সাথে যায় না, এই গান আমাকে অন্যভাবে গাইতে হবে। তুমি কি আমার গান আবার রেকর্ডিং করবে?’ শুনে বিকাশ খানসাহেবের পায়ে নিজের মাথা ঠেকিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া হবে গুরুজী’।  শুরু হোল আবার নতুন করে রেকর্ডিং, সুরমন্ডলের তারে ঝঙ্কার দিলেন তিনি আর সুরের ঝর্নাধারা বেয়ে নেমে এল, ‘ক্যা করু সজনি, আয়ে না বালম’।   বাংলা ছবির ইতিহাসে এই ‘বসন্তবাহার’ ছবিটিতে প্রথম বাংলা প্লেব্যাক করলেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান।     

 


 
বিকাশ রায় অভিনীত ছবির পোস্টার

 

রাজেন তরফদার পরিচালিত জীবনকাহিনী ছবিতে বিকাশ রায় ও অনুপকুমার

প্রযোজক ও পরিচালক হিসাবে বিকাশ একটা বৈশিষ্ট মেনে চলতেন। নিছক বয় মিটস গার্ল জাতীয় ছবি করা থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখতে ভালোবাসতেন তিনি যেটা ওনার তৈরি ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সারাজীবনে বিকাশ প্রায় আড়াইশো ছবিতে ছোটবড় নানারকম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, এর মধ্যে প্রায় ষাট-সত্তরটা ছবিতেই তিনি নায়ক বাকীগুলি পার্শ্ব-চরিত্র বা খলনায়কের।  এগুলোর পর্যালোচনা করা প্রায় অসম্ভব কাজ এবং লেখাটিও তথ্যভারে দীর্ঘায়িত হবে।  তবে অধিকাংশ ছবিতেই জড়িয়ে আছে নানাধরনের মজার ঘটনা যেগুলি তিনি নিজের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মনে পড়ে’, যেটি একসময় আনন্দলোক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত পরে বই আকারে প্রকাশ পায়, ‘কিছু কথা কিছু স্মৃতি’ এবং কিছু ছবি কিছু গল্প’-তে উনি জানিয়ে গেছেন।   ‘বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট সংস্থা’ তাঁকে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ও ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবিতে অসাধারন অভিনয়ের জন্য তাঁকে বিশেষ পুরস্কারে সন্মানিত করে। কিন্তু হায় এছাড়া সরকার পক্ষ থেকে তেমন কিছু পুরস্কার তাঁর কপালে জোটে নি বাংলা চলচ্চিত্রের বিশেষ অবদানের জন্য, আর অভিমানী বিকাশ এর জন্য কোনদিন কোন অভিযোগ করেন নি।   

 

বিকাশ রায় অভিনীত ছবির পোস্টার

তাঁর নিজের অভিনীত প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে তিনি উল্লেখ করতেন 'ছদ্মবেশী' ছবিতে খামখেয়ালি কিন্তু আদরণীয় ব্যারিস্টার প্রশান্ত ঘোষের ভূমিকা, জীবনকাহিনী ছবির একজন ব্যর্থ বিমার দালাল চরিত্র নবজীবন চক্রবর্তী, মরুতীর্থ হিংলাজ ছবির অবধূত চরিত্রটি,  'উত্তরফাল্গুনী' স্বার্থহীন প্রেমিক চরিত্র মনীশ, ছবিতে একজন উকিল হিসাবে সওয়াল করার সময় বিকাশের আগের আইনীপেশাটা খুব কাজে লেগেছিল।   পর্দায় গল্পের নানাধরনের মানসিক টানাপোড়েন বিকাশ ফুটিয়ে তুলেছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে, ছবিতে তাঁর মুখের এক্সপ্রেশন ও ব্যারিটোন ভয়েস তৈরি করেছিল কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, এর পাশাপাশি দাপুটে শরীরী ভাষাও ছিল এই ছবির অভিনয়ের অনুষঙ্গ    অপর আর একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র ‘জীবনমশাই’। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের লেখা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৯ এ রিলিজ হওয়া ছবি ‘আরোগ্য নিকেতন’।  পরিচালক বিজয় বসু যখন বিকাশকে এই উপন্যাসের ‘জীবনমশাই’ চরিত্রটি যখন করতে বলেন তখন বিকাশ একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন, কারণ উপন্যাসটি তাঁর আগেই পড়া এবং এই মুখ্য চরিত্রটিতে রূপদান করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ।  ছবিতে বৃদ্ধ জীবনমশাই ছিলেন একজন আয়ুর্বেদশাস্ত্রী যিনি নাড়ী টিপে রোগীর নিদান দেন এবং এই শাস্ত্রের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস।  অপরদিকে প্রদ্যুত সেন নামে একজন এম বি বি এস ডাক্তার ও ঘটনাচক্রে নবগ্রামে আসেন ডাক্তারি করতে। সঙ্ঘাত বাধে প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্র ও এলপ্যাথি-র।  প্রদ্যুত মেনে নিতে পারে না মান্ধাতা আমলের এই শাস্ত্র।  ঘটনাচক্রে বৃদ্ধ জীবনমশাই জানতে পারেন ডঃ প্রদ্যুত সেন তাঁরই নাতি, বহুবছর আগে তাঁর ছেলে অসবর্ণ বিবাহ করায় গোঁড়া জীবনমশাই ছেলেকে তাজ্যপুত্র করেন।  অবশেষে আজীবন নিজের জেদের কাছে মাথা উঁচু করে চলা জীবনমশাই নিজের বিবেকের কাছে পরাজিত হলেন এবং স্বীকার করে নিলেন নিজের বংশের একমাত্র প্রদীপকে।  ছবিতে ডঃ প্রদ্যুত সেন-এর ভূমিকায় ছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়।  বিকাশের নিজের কথায় বৃদ্ধ জীবনমশাই চরিত্রচিত্রন ফুটিয়ে তুলতে তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে কষ্ট দিয়ে দৃশ্যগুলোকে ফোটানোর চেস্টা করতেন এবং তিনি এই ব্যাপারে পুরোপুরি সফল।  তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের বিশেষ প্রশংসা পেয়েছিল এই ছবিটি, যেটা বিকাশ মনে করতেন কোন পুরস্কারের থেকে সেটা কম নয়। 

 

আরোগ্য নিকেতন ছবিতে বিকাশ রায় ও শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন আমি সিরাজের বেগমছবিতে বিকাশ রায়ের সাথে তাঁর অভিনয়ের কথা। ছবিতে বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর চরিত্রে ছিলেন বিকাশবাবু। সিরাজের ভূমিকায় বিশ্বজিৎ। শট দেওয়ার সময় বিশ্বজিৎ-এর মনে হত, বিকাশ রায়ের মিরজাফর যেন একটু ভালমানুষ গোছের। চুপচাপ বসে মালা জপছেন, আর মাঝে মাঝে মুদ্রাদোষের মতো ঘাড় হেলিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। ক্রূরতার প্রকাশ কি কম হচ্ছে? তখন সংশয় ছিল বিশ্বজিতের। কিন্তু ছবি দেখার পর বিশ্বজিৎ বলছেন, ‘মিরজাফর চরিত্রকে কী অসীম দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন বিকাশদা।  ওই ঠান্ডা দৃষ্টিতে কী অসম্ভব কুটিলতা, ভাবা যায় না!’

মৃণাল সেন পরিচালিত নীল আকাশের নীচে ছবিতে বিকাশ রায় ও মঞ্জু দে

 একটা চাপা দুঃখ হয়তো ছিল বিকাশের মনে, পরিচালক মৃণাল সেন তাঁকে নিজের ছবিতে অভিনয়ের জন্য ডাকলেও ডাক পান নি সত্যজিৎ রায় অথবা ঋত্বিক ঘটকের মতো পরিচালকের কাছ থেকে। দুজনের কাজকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন বিকাশ। মৃণাল সেন-এর ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে অভিনেত্রী মঞ্জু দে-র বিপরীতে বিকাশ অভিনয় করলেও এরপর মৃণালবাবুর কাছ থেকে তেমন আর ডাক পাননি বিকাশ।   এরপর সত্তর দশক থেকে আস্তে আস্তে ছবি করা কমিয়ে দিতে থাকলেন বিকাশ। চরিত্র পছন্দ না হলে তিনি পরিচালকদের ফিরিয়ে দিতেন, নিজেও আর প্রযোজনা ও পরিচালনার ধকল নিতে পারছিলেন না। বোধহয় কিছুটা অনুভব করেছিলেন এবার একটু থামা দরকার।  

শেষপর্বে থাকবে থিয়েটার ও বেতারনাট্য জগতে বিকাশ রায় 

 যদি প্রথমপর্ব এখনো পড়া না হয়ে থাকে তাহলে এখানে ক্লিক করুন । 

 ‘সূর্যমুখী’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গানটি আজও সমান জনপ্রিয়। 

                 কেরী সাহেবের মুন্সী ছবিতে শ্যামল মিত্রের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান


     

                বসন্তবাহার ছবির সেই বিখ্যাত গান গোলাম আলি সাহেবের 

                                                    বাকীটা পড়ার জন্য তৃতীয় পর্বে আসুন 

 

২টি মন্তব্য:

Rakesh K. Das বলেছেন...

দারুণ লাগল।

Unknown বলেছেন...

প্রবীর বাবু,শুধু আপনার নয়, বিকাশ রায় আমাদেরও অন্যতম প্রিয় অভিনেতা। আপনার উল্লেখিত প্রতিটি সিনেমার বিশ্লেষণ যথাযথ। ৪২' বা 'জিঘাংসা " বললই বিকাশ রায় অভিনিত চরিত্রের।কথাই আগে মনে পড়ে। খুব ভালো লাগল লেখা টা। এর আগেও "ছায়াসূর্য" সিনেমা নিয়ে লিখেছেন। সেই লেখাও ভালো লেগেছিল। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল