Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১

চেনা গানের অজানা কথা ১১

 

চেনা গানের অজানা কথা ১১

 

আজ চেনা গানের অজানা কথার এপিসোডটি একটি দেশাত্ববোধক গানের উপর জেতার উপর দুই বাংলার আবেগ জড়িয়ে আছে। গেয়েছিলেন ঝুমুর গানের অন্যতম শিল্পী অংশুমান রায়। এই বছর সেই গানটি বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতার পাশাপাশি ৫০ বছর পার করল।  

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

১৯৭১ সাল ছিল একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাসের বছর।  পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী পাক সেনারা নির্বিচারে বাংলাদেশের নিরীহ জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ, লুট করে চলেছিল।  প্রানভয়ে প্রচুর শরণার্থী একবস্ত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।   ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ ঢাকার তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে বহু নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর একটি কালজয়ী ভাষণ বাংলাদেশের সেইসব জনগণের

মুক্তিযুদ্ধের সেইসব সুপার হিরোরা

কাছে একটা শক্তি ও প্রেরনা জুগিয়েছিল। সেই আগুন ঝরানো উদ্দীপনা জাগানো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ভাষণ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ‘ইউনেস্কো’ অন্যতম ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ভাষণের একটি বিশেষত্ব ছিল যে এটি একটি সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিত বক্তৃতা। কোনরকম কাগজ বা নোট ছাড়াই তাঁর মুখনিঃসৃত এই ভাষণ প্রকাশ পেয়েছিল একেবারে তাঁর হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে।  ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ মানুষের মতো অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়’,  ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’, মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরও রক্ত দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বই ইনশাআল্লাহ্‌। আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা , জয় বাংলা’। 

 

অপরদিকে পশ্চিমবাংলাতেও এই ভাষণের বেশ প্রভাব পড়েছিল।  সময়টা ১৯৭১-এর এপিল মাসের ১৩ তারিখ।  কলকাতার দক্ষিণে যে গড়িয়া এলাকা, সেটা তখনও এখনকার মতো শহরের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েনি ওই শহরতলি অঞ্চলের বেশির ভাগটাতেই গড়ে উঠেছে ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের কলোনিরামগড়ের পদ্মশ্রী সিনেমা হলের কাছেই একটা চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা বসত ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা কয়েকজন গীতিকার, সুরকার আর গায়কের।  যথারীতি সেইদিন সকালে 

বাঁ দিক থেকে: অংশুমান রায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার,  

অমিতাভ নাহা, দিনেন্দ্র চৌধুরী

 


চায়ের একটি গোলটেবিলে জোর আড্ডা হচ্ছিল গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, তৎকালীন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসঙ্গীতের অধ্যাপক এবং সেই সময়ের একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিক্ষক দিনেন্দ্র চৌধুরী, ঝুমুর গায়ক অংশুমান রায় ও আকাশবানীর উপেন তরফদার-এর মধ্যে। আড্ডার বিষয়বস্তু অবশ্যই বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরবিক্রমে পাকসৈন্যদের অত্যচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।  সেই সময় রাতের দিকে আকাশবানী কোলকাতার একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল, ‘সংবাদ বিচিত্রা’।  প্রবাদপ্রতিম দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দাত্ত কণ্ঠের ভাষ্যপাঠসম্বলিত এই অনুষ্ঠানের প্রধান কারিগর ছিলেন উপেন তরফদার।  বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনাবহুল জায়গা থেকে সরাসরি প্রতিবেদন তুলে সম্প্রচারিত হত বেতারে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি খবর তুলে আনতেন এই অনুষ্ঠানের প্রতিবেদকরা।  প্রনবেশ সেন, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন তরফদারদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ছিল বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের, তাঁরা নিজেরাও সেখানে বহুবার যেতেন প্রতিবেদনের তাগিদে।  আড্ডা চলাকালীন উপেনবাবু তাঁর সংবাদ সংগ্রহের নানা নেপথ্য ঘটনা এবং ওপার বাংলার পরিস্থিতি নিয়েই কথাবার্তা বলছিলেন এবং সঙ্গে থাকা একটি ছোট স্পুল টেপরেকর্ডারে শোনাচ্ছিলেন গতমাসের সেই ৭ই মার্চের রেকর্ডিং করা বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ।  সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই ভাষণ শুনছিলেন কিন্তু গৌরীপ্রসন্ন চুপচাপ শোনার ফাঁকে ফাঁকে একটা চারমিনার সিগারেটের প্যাকেটের মধ্যের সাদা কাগজে কি যেন খসখস করে লিখে যাচ্ছিলেন আর মাঝেমধ্যে টুকটাক কথাবার্তাও বলছিলেন।   কিছুক্ষণ পরে তিনি বন্ধু অংশুমান ও  দিনেন্দ্রর হাতে ওই সিগারেটের প্যাকেটের কাগজটা দিয়ে বলেন, “দেখ তো চলবে কী না এটা?” অংশুমান রায় ওটা পড়েই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলে বসলেন, “গৌরীদা এটা আপনি কিন্তু আর কাউকে দিতে পারবেন না, এটা আমি সুর করব আর আমি নিজেই গাইব।"   বলামাত্র সবাই হইহই করে হাজির হলেন অংশুমান রায়ের বাড়ী এবং তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুধুমাত্র হারমোনিয়াম দিয়ে গানটার সুর বেঁধে ফেললেন অংশুমানএকটা শক্ত মলাটের গানের খাতায় দিনেন্দ্র চৌধুরী তাল ঠোকার পাশাপাশি  হারমোনিয়াম বাজিয়ে অংশুমান রায় গাইলেন বন্ধু গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সেই বিখ্যাত গান, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের/ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রনি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশদূরদর্শী উপেন তরফদার সেদিন বুঝেছিলেন এই গান একদিন ইতিহাস সৃষ্টি করবে তাই কালবিলম্ব না করে সঙ্গে থাকা ওই স্পুল টেপ রেকর্ডারেই গানটা রেকর্ড করে নিলেন।   

 

সেই দিন রাত্রেই ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে বাজানো হোল সেই গান এর ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু কিছু স্মরণীয় অংশ। হয়তো আজও সেটা আকাশবাণীর আর্কাইভে সুরক্ষিত রয়েছে।  পরের দিন বেশ হইচই পড়ে গেল, সবার মুখে একটাই প্রশ্ন এমন গান কে গাইলেন এবং সেই প্রথম অংশুমান রায় লোকগানের গণ্ডি পেরিয়ে এমন একটি গান গাইলেন যা দুই বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকল।   গানটির জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছল যে কিছুদিন পরে এই গানটি অংশুমানবাবু হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ড করার ডাক পান।   রেকর্ডের অপরপিঠে গানটির একটি ইংরেজি ভার্শনও ছিল, ‘A Million Mujiburs Singing’ এবং সেটারও অনুবাদক ছিলেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও অংশুমান রায়ের সাথে এই গানের সহশিল্পী ছিলেন করবী নাথ।  রেকর্ডে এইগানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন দিনেন্দ্র চৌধুরী।

হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে বেরনো সেই রেকর্ড

 ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কয়েকবছর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিজে অংশুমান রায়কে এই গানের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ড মেডেল’ দেওয়ার কথা সরকারীভাবে ঘোষণা করেন কিন্তু হাতে আমন্ত্রণপত্র থাকা সত্ত্বেও অংশুমানের আর বাংলাদেশ যাওয়া হয়ে ওঠেনি কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ভোরবেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডি-এর বাসভবনে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে  হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের আদর্শিক পটপরিবর্তন বলে বিবেচিত  প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট দিনটি ভারতবাসীর কাছে মুক্তির দিন হলেও ওইদিন বাংলাদেশেজাতীয় শোক দিবসহিসেবে পালিত হয় অবশেষে ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অংশুমান রায়কে এই গানটির জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সন্মান জাতীয় সন্মান, ‘মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সন্মান এবং মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সন্মান’ প্রদান করেন।  প্রয়াত অংশুমান রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি তাঁর পুত্র ভাস্কর রায় বাংলাদেশ সরকারের অতিথি হয়ে পিতা অংশুমান ও সারা ভারতবাসীর পক্ষে সেই সন্মান গ্রহন করেন।   আজ এতো বছর পরেও এই গানটিকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্মান জানানো হয় এবং প্রতিটি সরকারী অনুষ্ঠানে অন্যান্য দেশাত্ববোধক গানের সাথে সাথে বাজানো হয়, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের/ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রনি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। 

- প্রবীর মিত্র - ২৭/১২/২০২১  

 

 অংশুমান রায়ের সেই কালজয়ী গান

 A Million Mujiburs Singing

কোন মন্তব্য নেই: