Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১

বাংলা ছবির এক মেঘে ঢাকা তারার কথা

 

বাংলা ছবির এক মেঘে ঢাকা তারার কথা

প্রবীর মিত্র

‘পথের পাঁচালী’ কিছুদিন আগেই রিলিজ করেছে এবং জনমানসে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে।  সত্যজিৎ রায় এবার হাত দিলেন তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘অপরাজিত’–এর কাজে।  একদিন বিকেলে চলে গেলেন চেতলায় সখের সুরসাধক নরেন্দ্রনাথ বর্মনের বাড়ীতে।  নরেনবাবুর সুন্দর মুখশ্রীর অধিকারী ১২ বছরের কিশোরী মেয়ে তন্দ্রাকে রায়বাবু মনে মনে নির্বাচন করেছেন ‘অপরাজিত’ ছবিতে কিশোর অপুর কিশোরী প্রেমিকা, লীলার চরিত্রে।  কয়েকটি দৃশ্যের শুটিং হোল বেশ কিছুদিন ধরে শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন-এ, বাবা নরেন্দ্রনাথ ভীষণ খুশী, প্রবল উৎসাহ দিতে থাকলেন মেয়েকে, ইতিমধ্যে একসঙ্গে দেখে এলেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি।  কিন্তু সত্যজিৎবাবু ছবির এডিটিং-এর সময় সিদ্ধান্ত নেন ছবিতে অপুর মা ছাড়া আর কোনও মহিলা চরিত্র ছবিতে রাখবেন না, ফলে তন্দ্রা বর্মণের সাথে কিশোর অপুর প্রেমপর্বের অংশে কাঁচি পড়ল এবং জীবনের প্রথম ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের মতো ব্যাক্তিত্বের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েও বাদ পড়লেন বাংলা ছবির একসময়ের অতি জনপ্রিয় অভিনেত্রী তন্দ্রা বর্মণ।  

 

অভিনেত্রী তন্দ্রা বর্মণ

 ১৯৪২ সালের ৩১শে আগস্ট বারুইপুরে মামার বাড়ীতে তন্দ্রার জন্ম এবং ছোটবেলা তাঁর সেখানেই কেটেছিল, যদিও তাঁদের আদি নিবাস ছিল হুগলীর সিঙ্গুরে।  এরপর তাঁরা সপরিবারে কোলকাতার চেতলা অঞ্চলে একটি বাড়ীভাড়া করে চলে আসেন। পরে চলে যান হিন্দ সিনেমার কাছে একটি ফ্ল্যাটে।  ছোটবেলা থেকেই বাবা নরেন্দ্রনাথের উৎসাহে নাচ,গান ও সেতারবাদনে বেশ পারদর্শিনী হয়ে উঠেছিলেন তন্দ্রা।  সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে নরেন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। তখন প্রেমেন্দ্রবাবু ‘দুই তীর’ নামে

এক টুকরো আগুন ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে

একটি ছবির কাজ শুরু করেছেন।  একজোড়া মায়াবী চোখ ও সুন্দর মুখের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র তন্দ্রাকে নির্বাচন করলেন ছবিতে, কিন্তু এটিও কিছুদিন শুটিং হবার পর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এরপর গোবিন্দ বর্মণ প্রযোজিত ‘ভিজে বেড়াল’ ছবিতে অনুপকুমারের বিপরীতে সুযোগ পেলেন তন্দ্রা।    কিন্তু এই ছবিও মুক্তির আলো দেখল না।  তখন কিশোরী তন্দ্রা হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেও হাল ছাড়েন নি তাঁর বাবা।   অবশেষে ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘তানসেন’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করলেন ষোড়শী তন্দ্রা, পরিচালক নীরেন লাহিড়ী।  হয়তো আগের অভিনীত ছবিগুলিতে প্রবল হতাশার কারণে এই ছবিতে মনপ্রান ঢেলে অভিনয় করেছিলেন তন্দ্রা।  
সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত ছবিতে স্মরণ ঘোষালের সাথে তন্দ্রা

১৯৬০ সালে অভিনেতা বিকাশ রায় তন্দ্রাকে ডেকে নিলেন তাঁর নিজের পরিচালিত ছবি ‘কেরি সাহেবের মুন্সি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য।  ছবিতে তন্দ্রার পাশাপাশি অভিনয় করেছিলেন তৎকালীন তাবড় সব অভিনেতা অভিনেত্রীরা যেমন, ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে, পাহাড়ি সান্যাল, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পীগণ।  ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি তন্দ্রাকে বাংলা চলচ্চিত্রের লাইমলাইটে আনতে খুব সাহায্য করেছিল। সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে এই ছবির গানগুলি গেয়েছিলেন গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।
  ছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে একটি গান ‘কি হোল রে জান, পলাশী ময়দানে নবাব হারল তাঁর প্রাণ’ সেইসময় লোকের মুখে মুখে ফিরত।   

 অভিনেতা বিকাশ রায় সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

 পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬২ সালে পরিচালক অজয় কর, লেখিকা প্রতিভা বসুর কাহিনী অবলম্বনে   ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় বড় একটা ব্রেক দিলেন তন্দ্রা বর্মণকে, বিপরীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সাথে

ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।  ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ছায়া দেবী, ছবি বিশ্বাস, জহর রায়ের সাথে চুটিয়ে অভিনয় করেছিলেন তন্দ্রা।   এর আগে  তন্দ্রার ঝুলিতে ছিল মাত্র দুটি মুক্তি প্রাপ্ত ছবি, ‘তানসেন’ ও ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’।  একেবারে আনকোরা তন্দ্রাকে নায়িকার ভূমিকায় নির্বাচন করার জন্য পরিচালক অজয় কর একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।  কিন্তু তাঁর আগের দুটি ছবিতে তন্দ্রার অসাধারন অভিনয় অজয় করকে মুগ্ধ করেছিল।  এই ছবিতে তন্দ্রা বর্মণের লিপে একটি গান ছিল, ‘ভুল সবই ভুল’ – এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল, এই শ্রাবণে মোর ফাগুন  যদি দেয় দেখা সে ভুল, ভুল সবই ভুল’। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানটি গেয়েছিলেন সুজাতা চক্রবর্তী।  গানটি
ছবির পোস্টার

এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সেইসময় প্রায় নিয়মিত ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানে রেডিওতে এই গান বাজত।  এই একটিমাত্র গান গেয়ে সুজাতা চক্রবর্তী সকলের কাছে পরিচিতি পেলেন, কিন্তু হায় এরপর কোন এক অজানা কারণে সুজাতাদেবীর কণ্ঠে আর কোন গান প্রকাশ পায় নি রেকর্ডে।   কোথা থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো এক সুরের জহুরী সুজাতাকে খুঁজে বের করলেন অথচ তাঁর পরবর্তী কোন ছবিতে বা বেসিক গানে গায়িকা সুজাতাকে আর কোন সুযোগই দিলেন না, সেটা আজও এক গভীর রহস্য।  এই একটি মাত্র জনপ্রিয় গান গেয়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন সুজাতা চক্রবর্তী।   ১৯৬২ সালের ২৫ শে মে কোলকাতার বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ, শ্রী, লোটাস ও ইন্দিরাতে মুক্তি পায় অজয় কর পরিচালিত ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিটি।   আজ এতো বছর পরেও এই ছবি ও ছবির এই গানটি সমান জনপ্রিয়। 

এরপর একে একে মুক্তি পায় তন্দ্রা বর্মণ অভিনীত ‘দুই বাড়ী’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘এক টুকরো আগুন’, ‘সেবা’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’, ‘চেনা মুখ’ ইত্যাদি ছবি। এইসব ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন অসিতবরন, বিশ্বজিৎ, কালী ব্যানার্জি প্রমুখ শিল্পীদের সাথে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এক টুকরো আগুনছবিতে বিশ্বজিতের বিপরীতে তিনি অভিনয়ের সাথে সাথে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ওগো মোর প্রিয় বন্ধুগানটি তাঁর লিপে খুবই জনপ্রিয় হয়।  প্রচুর ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেও, চরিত্র মনের মতো হয়নি বলে, অনেক ছবি করেননি। শোনা যায়, তপন সিংহেরহাঁসুলী বাঁকের উপকথাছবিটিরও প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭০সালের নভেম্বর মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি, ‘মঞ্জরী অপেরা’ ছবিতে উত্তমকুমারের সন্দেহবাতিকগ্রস্থ স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন তন্দ্রা। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে এই ছবির পরিচালক ছিলেন অগ্রদূত।  তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ছিল ‘আমি রতন’, ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের আর এক জনপ্রিয় অভিনেতা রজ্জাক।  তন্দ্রার অভিনয়দক্ষতা গুরু দত্তেরও নজর এড়ায় নি তাই তিনি তন্দ্রাকে বোম্বাইতে ডেকে পাঠান একটি ছবির শুটিং-এর জন্য।  গুরু দত্ত বিখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিসের মুখের সাথে তাঁর মুখের বেশ মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।  গুরু দত্তের ছবিতে অভিনয়ের শুটিং চলাকালীন তাঁর অকাল মৃত্যুতে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ভগ্নহৃদয়ে তন্দ্রা আবার কোলকাতায় ফিরে আসেন।    

 

১৯৭২ সালে তন্দ্রা বিয়ে করেন সেনাবাহিনীর অফিসার দ্বিজেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং তাঁদের একটি পুত্রসন্তানও হয়। এরপর থেকেই রূপোলী পর্দার জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তন্দ্রা বর্মণ।  সাফল্যের মধ্যগগনে থাকা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দিতে থাকেন একের পর এক ছবির অফার।  ২০০৪ সালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একটি থ্রিলার সিরিজের একটি এপিসোডে তাঁকে শেষবার জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল এবং তারপরই তিনি অভিনয় জগত থেকে পাকাপাকিভাবে সরে আসেন এমনকি বাইরের জগতের সাথেও তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এ যেন অনেকটা আমাদের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মতো।  হয়তো তিনি এসব করেছিলেন পারিবারিক দ্বায়িত্ব অথবা সিনেমা জগত সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গের কারণে।  সত্যজিৎ রায়ের ছবি থেকে বাদ পড়ে যাওয়াটাও তিনি ভুলতে পারেন নি আজীবন পাশাপাশি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের সাথে একসঙ্গে অভিনয় করতে না পারার আফসোসও তাঁর মধ্যে ছিল।  জীবনের শেষ কটা দিন তিনি দক্ষিন কোলকাতার প্রতাপাদিত্য রোডের একটি বাড়ীতে থাকতেন এবং অত্যন্ত সাধারন জীবনযাপন করতেন।  দোকান, বাজার বা ব্যাঙ্কে তিনি যখন কোন কাজে যেতেন তখন তাঁকে কেউ অতীতদিনের খ্যাতনামা অভিনেত্রী তন্দ্রা বর্মণ হিসাবে কেউ চিনতেই পারেন নি। আসলে চিত্রতারকাসুলভ গ্ল্যামারাস জীবনযাপনে তিনি একেবারেই অভ্যস্ত ছিলেন না।  ২০১৮-এর ১৯শে ফেব্রুয়ারি ওরাল ক্যান্সারে তিনি আক্রান্ত হয়ে তিনি চিরকালের জন্য হারিয়ে যান।  না তিনি চলে যাবার পর কোন

জীবনের শেষ প্রান্তে তন্দ্রা বর্মণ

মিডিয়া হাউস তাঁর মৃত্যুর খবর কভার করেনি হয়তো ছবির জগত থেকে সরে গেলে মিডিয়াও তাদের চিরতরে ভুলে যায়। সেদিন এই প্রজন্ম জানতেও পারেনি বাংলা ছবির এক মেঘে ঢাকা তারকা নিঃশব্দে শববাহী গাড়িতে ফুলে সুসজ্জিতা হয়ে চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। তবু
‘অতল জলের আহ্বান’ সিনেমার একটা গান তার সাথে তাঁর অবিস্মরনীয় অভিনয় তাঁকে সারাজীবন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর করে রাখবে।

 

তথ্যঋণ ঃ এই সময়, আনন্দবাজার, দ্যা ওয়াল। 

 

 

 

 সুজাতা চক্রবর্তী গাওয়া সেই বিখ্যাত গান যেটি তন্দ্রা বর্মণের লিপে ছিল

 


সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান ওগো মোর প্রিয় বন্ধু গানের লিপে তন্দ্রা বর্মণ ১৯৬৩ তে রিলিজ হওয়া 'এক টুকরো আগুন' ছবিতে   

কোন মন্তব্য নেই: