Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

অপরাজিত সৌমিত্র

 

অপরাজিত সৌমিত্র

 ‘আমি মৈনাক । হিমালয়ের পুত্র মৈনাক । ডানা যার সমুদ্রে লুকানো’ ।

১৮৬৬ সালে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তাঁর নাটকের চরিত্র নিমচাঁদের মুখে বসিয়েছিলেন এই সংলাপ । নাটকের নাম ‘সধবার একাদশী’ ।  সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ১৯৫৯ এর ছবি ‘অপুর সংসার’ – এ এই সংলাপ আবার বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।  ছবিতে আমরা দেখি বন্ধু পুলুর (অভিনয় করেছিলেন স্বপন মুখোপাধ্যায়) সাথে ‘সধবার একাদশী’ নাটকটি দেখার পর অপু যখন  রাত্রির অন্ধকারে চিৎপুর রেল ইয়ার্ড সংলগ্ন এরিয়া দিয়ে ফিরছিল তখন অপু পরম তৃপ্তিতে তাঁর জীবন দর্শনের কথা পুলুর সাথে ভাগ করে নিচ্ছিল ।  তখন অপুর ভূমিকায় সৌমিত্রকে যেন বড্ড ভালো লেগে যায় ।   গ্রামের একটি দরিদ্র ছেলে শহরে এল, সে বাপের মতো পুরুতগিরি করতে চায় না, পড়াশুনোর মাধ্যমে, সংগ্রামের মাধ্যমে তাঁর সমস্ত কুসংস্কার, গোঁড়ামি কাটাতে চায় । বুদ্ধি দিয়ে সে সব কিছু বিচার করতে চায় ।  কিন্তু তার কল্পনাশক্তি থাকবে, অনুভূতি থাকবে – ছোটখাট জিনিস তাকে মুভ করবে – তাকে আনন্দ দেবে । হয়তো তার ভিতরে মহৎ কিছু একটা করার ক্ষমতা আছে, সম্ভবনা আছে কিন্তু করছে না । কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয় – সেটা ট্র্যাজেডিও নয় – সে মহৎ কিছু করছে না – তার দারিদ্র্য যাচ্চে না – তার অভাব মিটছে না – তা সত্ত্বেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না – সে পালাচ্ছে না, এস্কেপ করছে না – সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, তার মধ্যেই আছে আনন্দ… হি ওয়ান্টস টু লিভ… । অপু কোন চাকরি করতে চায় না, কেরানী হতে চায় না সে শুধু লেখক হতে চায় । নভেল লিখতে চায় ।  আর আত্মজীবনী ? হয়তো কিছুটা আর বাদবাকিটা বানানো ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
                                 

না সৌমিত্রবাবু, আপনি কথা রাখলেন না । আত্মজীবনী লেখার আগেই আপনাকে চলে যেতে হোল ।  গত প্রায় ৪০ দিন ধরে আমরা, যারা আপনার গুণগ্রাহী, প্রত্যেকেই এক একজন ‘কোনি’ গল্পের  ‘খিদ্দা’ হয়ে গিয়েছিলাম ।  সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে ভরিয়ে দিয়েছিলাম ‘ফাইট ফেলুদা ফাইট’ লিখে, ঠিক যেভাবে জলে সাঁতরানো ক্লান্ত, শ্রান্ত ‘কোনি’ কে আপনি বলেছিলেন ‘ফাইট কোনি ফাইট’ ।   কিন্তু মারন কোভিড ভাইরাসের কাছে আপনার মগজাস্ত্র ও শরীর পরাজিত হোল ।   প্রথম যৌবনে শিশির ভাদুরীর অভিনয় দেখেই আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন প্রথাগত চাকরি নয়, অভিনয় করবেন ।  তৎকালীন নাট্যব্যাক্তি, অহিন্দ্র চৌধুরী আপনাকে শিখিয়েছিলেন অভিনয়ের খুঁটিনাটি ।  কিন্তু আপনি বুঝলেন কিছু একটা করা দরকার । যোগ দিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও তে ঘোষক হিসাবে । 

সেখানে এক মজার ঘটনা ঘটেছিল, যেটা আপনার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় ।   অল ইন্ডিয়া রেডিও তে ঘোষকপদের ইন্টারভিউ-এর দিন আপনি দেখলেন প্রচুর লোক উক্ত পদের আশায় লাইন দিয়েছে আর আপনার ডাক কখন যে আসবে তার কোন ঠিক নেই । আর পদ মাত্র একটি । রাস্তার ধারে চা খেতে খেতে একজন সুদর্শন যুবকের সাথে আপনার আলাপ হোল । বয়েসে আপনার থেকে বছর চারেকের বড় হয়তো হবে ।   কথায় কথায় উনি আপনাকে জানিয়েছিলেন যে উনি সিনেমায় সহকারী পরিচালকের কাজও করেন । বেশ কিছু ছবিতে ছোটখাট রোলও করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে ।  যদি জীবনে কোন একটা বড় ব্রেক আসে তাহলে এই ঘোষকের চাকরীর ব্যাপারে তাঁর কোন আগ্রহ নেই ।  অবশেষে ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে আপনাদের ডাক এলো ।

অনিল চট্টোপাধ্যায়

 আপনি ইন্টারভিউ দেবার কিছুদিন পর গারস্টিন প্লেসের রেডিও অফিস থেকে আপনার নিয়োগপত্র এল ঘোষকপদের জন্য ।  চাকরিতে যোগ দেবার পর আপনি জানতে পেরেছিলেন সেদিন প্রচুর লোকের ইন্টারভিউ নেবার পর নিয়োগকর্তা আপনাকে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছিলেন, আর প্রথম স্থানে ছিলেন সেই ব্যাক্তি যার সাথে আপনার আলাপ হয়েছিল একটি চায়ের দোকানে এবং বেশ কিছুটা মধুর সময় আপনি কাটিয়ে ছিলেন তাঁর সঙ্গে ।  কিন্তু তিনি চাকরিটা নেননি শেষ পর্যন্ত কারণ তিনি ঋত্তিক ঘটকের একটি ছবিতে বেশ ভালো একটি রোল পেয়ে গেছেন । ছবির নাম ‘অযান্ত্রিক’ । কারণ তাঁর হয়তো স্থির বিশ্বাস ছিল যে এই ছবি থেকেই তিনি একটা বড় ব্রেক পাবেন আর পেয়েও ছিলেন । তিনি আর কেউ নন, বহু সফল বাংলা ছবির চরিত্রাভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়, যার সাথে আপনি পরবর্তীকালে অনেক বাংলা ছবি করেছেন ।  

১৯৫৭ সালে কপাল ঠুকে পরিচালক কার্তিক বসুর কাছে গেলেন  ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য । কিন্তু আপনার অভিনয় কার্তিক বাবুর পছন্দ না হওয়ায় আপনার জায়গায় এলেন অসীমকুমার ।  ১৯৫৬ তে সত্যজিৎ রায়ের সাথে আলাপ হলেও তাঁর পরিচালনায় অভিনয়ের জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হয় তিন বছর ।  তারপর এল প্রথম সুযোগ ১৯৫৯ এ সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ । 

অপুর সংসার ছবির প্রথম পোস্টার


সেই শুরু, তারপর সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ১৪ টি ছবি করার পাশাপাশি ডাক পেলেন মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুন মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, সরোজ দে ইত্যাদি পরিচালকদের সাথে কাজ করার ।  একটা আক্ষেপ হয়তো ছিল আপনার মধ্যে, পরিচালক ঋত্তিক ঘটক এর কাছ থেকে কোন ডাক আপনি পান নি।   তবে নানারকম সিনেমায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা সত্ত্বেও বলিউডের মোহ আপনাকে গ্রাস করতে পারে নি । একটা হিন্দি ছবিও আপনার ফিল্মগ্রাফিতে নেই ।  তবে ১৯৮১ সালে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল তাঁর ‘কলযুগ’ ছবিতে আপনাকে ভেবেছিলেন, শুটিং এর দিন আপনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় শুটিং ক্যানসেল করতে হয় ।  পরিচালক শ্যাম বেনেগাল আপনার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আপনি রাজী হন নি । ‘দ্যা শো মাস্ট গো অন’ এটা বুঝিয়েছিলেন পরিচালক শ্যাম বেনেগালকে ।  তখন আপনার জায়গায় কাস্ট করা হয় রাজ বব্বর-কে ।   দু একটি টেলি ফিল্ম ছাড়া হিন্দিতে আপনার কোন কাজ দেখা না গেলেও হলিউডের কয়েকটি ছবিতে আপনাকে দেখা গেছে । এই মুহূর্তে একটা ছবির কথা মনে পরছে ‘দ্যা বেঙ্গলি নাইট’ (১৯৮৮), যেটি মিরচা এলিয়াদের উপন্যাস ‘লা নুই বেঙ্গলী’ উপর নির্মিত ।  জন হার্ট, হিউ গ্রান্ট, শাবানা আজমি, সুপ্রিয়া পাঠক ইত্যাদির পাশাপাশি আপনার অভিনয় নজর কেড়েছিল আন্তর্জাতিক মহলে ।    অপর একটি আন্তর্জাতিক ছবি ‘Shadows of Time (2004)’, যেটির ভাষা বাংলা হলেও, এটি ছিল একটি জার্মান প্রোডাকশন । খুব কম দর্শকই এই ছবিটি দেখেছে আর এই ছবির একটা বিশেষ দিক হোল প্রয়াত অভিনেতা ইরফানের খানের সাথে এটাই আপনার একমাত্র অভিনয় ।  

চারুলতা ছবিতে মাধবীর চক্রবর্তীর সঙ্গে

উত্তমকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে
           

 কিনা করেন নি আপনি!, চলচিত্র অভিনয়ের পাশাপাশি ষ্টেজ অভিনয়, বাচিক শিল্পী, চিত্রকর এর পাশাপাশি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা ও সাহিত্য । আমার মতে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার অসাধারন আবৃত্তি যেন আপনার কণ্ঠেই মানায় । অপরদিকে শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে রবীন্দ্রকবিতা ও কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে নজরুল কবিতা । এটা অবশ্য সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব মতামত । 

                    অপুর সংসার ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য 

আরও একটি কাণ্ডও আপনি ঘটিয়েছিলেন । প্রথাভাঙ্গা একটি পোশাক আপনিই প্রথম আমাদের সামনে নিয়ে আসেন ।  আসলে সমস্ত চলচিত্র অভিনেতা অভিনেত্রীদের এক অলিখিত দায়িত্ব থাকে, সেটা হোল চালচলন, পোশাক-আশাকের মধ্যে দিয়ে অনুরাগী দর্শকদের উপর প্রভাব বিস্তার করা । ঠিক যে পথ ধরে ভোগ্য বস্তুর নানা উপকরণ সাধারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়ে ।  এর সার্থক উদাহরন হতে পারেন উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী বা সুচিত্রা সেন ।  আবার এর উলটোটাও আছে । যেখানে সাধারন মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই দেখা দেন নায়ক ।  সৌমিত্রবাবু, আপনি এই দ্বিতীয় প্রতিনিধিরই একজন । ১৯৬৫-তে মৃণাল সেন-এর ‘আকাশ কুসুম’ ছবিতে আপনি পরলেন সেই সময়ের এক প্রথাভাঙ্গা পোশাক । প্যান্টের উপর পাঞ্জাবী । তারপর থেকে এটাই হয়ে উঠেছিল ছাত্র ও যুবকদের একমাত্র পোশাক ।  সত্যজিৎ রায় এই পোশাক কিছুটা দেখিয়েছিলেন ‘অরন্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে ।  তারপর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে ফেলু মিত্তিরকে এই পোশাক পরালেন মানিকবাবু । পরবর্তী কালে সন্দীপ রায়ের ফেলুদারূপী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়কেও আমরা এই পোশাকে দেখেছি । পাঞ্জাবীর সাথে ঘন নীল ডেনিম জিন্স । এটা একেবারে প্রথাভাঙ্গা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে যায় যেটা আজও প্রচলিত আর সেটার ট্রেণ্ড সেটার   শুধুমাত্র আপনিই,  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।           

 

 প্রবীর মিত্র

১৬/১১/২০২০

বিশেষ কৃতজ্ঞতা ঃ  আনন্দলোক - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা, সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার সিনেমা, বিশেষ ঘোষণা, বেতারস্মৃতি - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ইন্টারনেট থেকে সমস্ত ছবি প্রাপ্ত ।  

 

৭টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

Bah bah.kotobtotthosomriddho lekha.mon chueye jay

Unknown বলেছেন...

দারুণ লেখা|অনেক গুলো তথ্য জানতে পারলাম |

Probir's Feel Notes বলেছেন...

অনেক ধন্যবাদ

manobkantho বলেছেন...

লেখাটি ভালো লাগলো। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে অনেক বানান ভুল আছে। সঠিক বানানগুলি হলো- সম্ভাবনা, অরণ্য, ভাদুড়ী, যাচ্ছে, তরুণ, সাধারণ, দ্য(The), চলচ্চিত্র, অসাধারণ ইত্যাদি।

নামহীন বলেছেন...

লেখাটি ভালো তাতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু ওনার নাট্যজীবন, বাচিক শিল্পীজীবন ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত হলে আরও ভালো লাগতো । আশা করি সেটা নিয়ে আগামীদিনে লিখবেন । ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন ।

Unknown বলেছেন...

Mon diye parlam. Khub bhalo laglo

Unknown বলেছেন...

Baba koto totthosomriddho lekha go।bah bah excellent।preservable vai