Advertisement

ফিরে দেখা সেইসব দিনগুলো, যেগুলো আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে রাখত

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০

বোরলীন - বঙ্গজীবনের অঙ্গ

 বোরলীন - বঙ্গজীবনের অঙ্গ 

“শীতের দিনে লেপ-কম্বল

কমলালেবুর কোয়া,

পশমজামা চড়ুইভাতি

নতুন গুড়ের মোয়া

এমনি না স্মৃতির সাথে জড়িয়ে চিরদিন

সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরলীন”

-      ঋতুপর্ণ ঘোষ

 

ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিলাম বলে মায়ের খুব চিন্তা ছিল । খালি তুলনা করা হোত আমার শান্তশিষ্ট দাদার সাথে । প্রায়ই স্কুল থেকে ফিরতাম শরীরে কাটাছেঁড়া নিয়ে, সেটা বন্ধুদের সাথে মারপিটই হোক বা ফুটবল খেলা, প্রচণ্ড বকুনির পর মা সস্নেহে লাগিয়ে দিত বোরলীন ।  বাবার দাড়ি কামানোর সময় ব্লেডে গাল কেটে গেলে দারুন হৈ চৈ, মা সঙ্গে সঙ্গে হাজির হত সবুজ রঙের একটা বোরলীন টিউব নিয়ে ।
গৌর মোহন দত্ত
বোরলীনের জনক শ্রীযুক্ত গৌর মোহন দত্ত
 
সেই সময় বিবিধ ভারতীতে শ্রাবন্তি মজুমদারের জিঙ্গল, তার সাথে সেইসময় বিজ্ঞাপন অফিসে চাকরি করা এবং তারপরে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা একটি ছড়া ও ফাটাফাটি কিছু দুর্ধর্ষ বেতার নাটকের দৌলতে বোরলীনের প্রচার এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল যে প্রায় প্রত্যেক বাঙ্গালীর সব সময়ের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল এই বোরলীন যা আজও অন্যকোন এন্টিসেপ্টিক ক্রিমের ভিড়ে হারিয়ে যায় নি । 
 

সময়টা ১৯২৯ সাল, শ্রীযুক্ত গৌরমোহন দত্তের হাত ধরে পত্তন হোল একটি কোম্পানি, জি ডি ফার্মাসিউটিক্যাল ।  ইতিহাসের অলিন্দে হাঁটলে দেখা যাবে সেই সময় স্বদেশী আন্দোলন বেশ বৃহৎ একটা আকার নিয়েছে ।   অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের অর্থনীতিক শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবের আগুন জ্বলছে ।  জোর দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র ভারতে তৈরি জিনিষের ব্যবহারের উপর, তার সাথে চলছে বিলেত থেকে আমদানি করা নানা ধরনের দ্রব্যসামগ্রী বর্জন,  ঠিক এই সময় যেমন মারন করোনার জন্য চিনকে দায়ী করা হচ্ছে ও তার সাথে বর্জন করা হচ্ছে সস্তার চিনাসামগ্রী ।   গৌরমোহন দত্ত এই স্বদেশী আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করতেন ।   তাঁর মাথায় সবসময় ঘুরত এমন একটি ক্রিম আবিস্কার করতে হবে যেটি বিলেত থেকে আমদানি করা ক্রিমের থেকে কোন অংশে কম নয় তার সাথে এটা যেন ছোটখাট কেটে বা ছড়ে যাওয়া থেকে ত্বককে রক্ষা করে ।  তিনটি উপাদান, যেমন  এন্টিসেপ্টিক বোরিক এসিড, জিঙ্ক অক্সাইড এবং আনহাইদ্রাস ল্যাননিন, এই সব নিয়ে তিনি তৈরি করলেন একটি সাদা রঙের ক্রিম । এই নতুন ক্রিমের নামকরন করতে গিয়ে তার মাথায় এল ‘এন্টিসেপ্টিক বোরিক পাউডার’ ও তেল-এর ল্যাটিন শব্দ ‘অলিয়াম’ , আর এই দুটো শব্দকে একত্রিত করে দাঁড়াল ‘বোরলীন’ ।  গৌরমোহন দত্তের নিজস্ব বাড়ীতেই ছিল এই বোরলীন তৈরির কারখানা ।  আজও উত্তর কোলকাতার গিরীশ এভিনিউতে গেলে এই বোরলীন হাউস চোখে পড়বে ।   

বোরলীনের পুরোন বিজ্ঞাপন

যেটা বলছিলাম, বোরলীন তো আবিস্কার হোল কিন্তু এটার লোগো কি করা যায় ?  অবশেষে অনেক চিন্তা করে তিনি ঠিক করলেন তাঁর প্রোডাক্টের লোগো হবে কোন মানুষ নয়, প্রাণী,  আর সেটা হোল হাতি, কারণ হাতি যেমন বিশাল, শক্তিশালী তেমনি ধীরস্থির ।  তাই হাতির ছবি প্রিন্ট করে একেবারে নামমাত্র দামে বাজারে এল বোরলীন আর কিছু দিনের মধ্যে সাড়া ফেলে দিল গৌরমোহন দত্তের এই আবিস্কার ।  তিনি প্রমান করে ছাড়লেন তাঁর প্রোডাক্ট বিলেত থেকে আমদানি করা সমগোত্রীয় কোন প্রোডাক্টের থেকে কোন অংশে কম নয় ।   সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি এই ক্রিম ব্যবহার করাটা একটা গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়াল ।

 ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট, ভারতের আসন্ন স্বাধীনতা উপলক্ষে, গৌরমোহন দত্তের পুত্র শ্রীযুক্ত দেবাশিস দত্ত মহাশয়, কোলকাতার খবরের কাগজগুলিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানালেন উনি ভারতের এই বিশেষ সময়ে উপহারস্বরূপ সবাইকে বোরলীনের একটি প্রোডাক্ট উপহার দিতে চান সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ।  ঠিক তার পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট উত্তর ও দক্ষিন কোলকাতার দুটি জায়গা থেকে প্রায় এক লক্ষের উপর

১৪ই আগস্টের সেই বিজ্ঞাপন

বোরলীন বিতরণ হোল, যেটা জি ডি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছে আজও খুব একটা গর্বের বিষয় ।  শোনা যায় জহরলাল নেহেরুর বিশেষ প্রশংসা পেয়েছিল এই ক্রিম ।  কোম্পানির প্রচারপ্ত্র জানাচ্ছে, ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞানী অদিতি পান্থের সঙ্গে এন্টার্কটিকা গিয়েছিলেন কোলকাতার সুদীপ্তা সেনগুপ্ত ।  সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাঁদের সঙ্গী ছিল বোরলীন ।  ভারতীয় সেই সমস্ত সেনা যারা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে তাঁদের জন্য এই ক্রিম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আজও বিতারিত হয় । 

এটা আজও একটা বিস্ময়ের ব্যাপার যে, ১৯২৯ সালে তৈরি হওয়া একটা প্রোডাক্ট আজও ২০২০ সালে সমান জনপ্রিয় শুধুমাত্র তার গুনগত মান ধরে রাখার জন্য । ২০১৫ সালে জি ডি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির আন্যুয়াল টার্নওভার ছিল প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আর এই টাকার প্রায় ৮০ শতাংশ এসেছিল শুধুমাত্র এই ক্রিম থেকে । সেই ২০০৩ সাল থেকেই ভারতের সুপার ব্রান্ডের মধ্যে অন্যতম স্থান অধিকার করে রেখেছে এই বোরলীন ।  বর্তমানে এই ক্রিমের পাশাপাশি জি ডি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আরও একটি প্রোডাক্ট বাজারে এনেছে সেটা হোল ‘এলিন’ মাথার তেল ।     জি ডি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি জানাচ্ছে যে বোরলীন তৈরির সময় যে সমস্ত আবর্জনা উৎপন্ন হয় সেগুলি বায়ো ডিগ্রেডবেল, অর্থাৎ এর দ্বারা পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না ।  ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়ে আজ বিদেশেও বোরলীনের চাহিদা খুব একটা কম নয় ।  

 

 
প্রবীর মিত্র
২৪/১১/২০২০ 

 

ঋণস্বীকার ঃ তথ্য ও সমস্ত ছবি ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত । 

লেখাটির প্রথম প্রকাশ ঃ  নিউজ ইন্ডিয়া প্রেস


 

1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

Durdhorsho lekha।Bangali sentiment ke jorse narie diecho।uhhh ki information